দুর্দান্ত কিছু স্প্যানিশ স্থাপনার গল্প-সুপ্রভা জুঁই||

Writers block বলে যে বিষয়টি লেখকদের ক্ষেত্রে খুব জনপ্রিয় আমার ধারণা তা পৃথিবীর যেকোন সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ, সৃষ্টিশীলতার সহজ প্রবাহে সৃষ্ট ভাঁটা। এই ভাঁটা স্থপতিদেরও হয় বৈকি। স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশুনা চলাকালীন শিক্ষার্থীদের মাঝে যে রোমাঞ্চকর উত্তেজনা কাজ করে শিক্ষকেরা সেই কল্পনায় পাখা জুড়ে দেন। শিক্ষা জীবনে তাই স্থাপত্য চর্চার ভাবনায় সীমাহীন এক বিচরণ ক্ষেত্রে তৈরি হয়। একটি প্রজেক্ট ও তার প্রোগ্রামকে জেনে বুঝে, তার নিগূঢ় সত্যকে খুঁজে বের করতে শিক্ষার্থী পুরো সেমিস্টার জুড়ে চেষ্টা করে। আর তার দীর্ঘ যাত্রার মধ্য দিয়ে লব্ধ জ্ঞানকে শিক্ষকের সহায়তায় ক্রমাগত ঝালাই করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে অবস্তুগত চিন্তার এক বস্তুগত রূপ দেয় শিক্ষার্থী। কিন্তু পরবর্তিতে পেশাগতভাবে স্থাপত্য চর্চার সময়ে শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। তখন একটা ফর্মুলাকে অনুসরণ করে বাক্সবন্দী প্রথাগত ধারাকে সঙ্গী করে এগোতে বাধ্য হতে হয়। এটা যে সকলের ক্ষেত্রে ঘটে তা নয়। কিন্তু সেই সকল স্বপ্নবাজ স্থপতিদের উদ্দেশ্যে স্পেনের কিছু আবাসিক প্রকল্প নিয়ে এই লেখাটি। যেখানে নাটকীয় ইন্টেরিয়রের জন্য আলাদা করে খাটার দরকার পড়ে না, বরং স্থপতির এক একটা লাইন যে স্পেস তৈরি করে দেয় সেটাই চূড়ান্ত নান্দনিকতার রসদ দিতে সক্ষম, যেখানে এক্সপেরিমেন্ট বা নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে, যেখানে স্থপতিরা পূণরায় নন্দন-তত্ত্বের সংজ্ঞা লিখছেন।

রুরাল হাউজ/ Rural House


আর সি আর আর্কিটেক্টস/ RCR architects


স্পেনের উত্তর-পূর্ব কোণ স্যান্টিয়াগোতে বহু বছর ধরে নানা মানুষ আসেন ধর্মীয় অনুভুতিকে লালন করে। ঠিক এইখানেই রয়েছে স্থাপত্যের এক তীর্থস্থান। এই অঞ্চলের স্থাপত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো নানা আকারের বিশাল পাথুরে ফার্ম-হাউজ। কিন্তু আমরা এই অঞ্চলের যেই বাসাটা সম্পর্কে জানবো সেটা একেবারেই এমন নয়। মরচে ধরা মেটাল দিয়ে তৈরি সেই বাড়ি। স্থাপত্যের নোবেল প্রিতজকার পুরস্কার প্রাপ্ত স্থাপত্য ফার্মটির এই প্রকল্পটি বহুল আলোচিত। দূর থেকে পাহাড়ের উপত্যকায় একটা সরু রেখার মতন দেখায় বাড়িটা।



টিলার একদম শেষ প্রান্তের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এই বাড়িটি। চোখ ধাঁধানো কোন কাঠামো নয় বরং কতগুলো বাক্স দেখা যায় কেবল। ভালো স্থাপত্য মানেই জটিল কাঠামো হতেই হবে কি? কোন কোন স্থাপনা বলে ‘আমাকেই দেখ’, কিন্তু এই স্থাপনাটি বলে, আমাকে দেখ না বরং তোমার সামগ্রিক বোঝাপড়ার পাঠটি এবারে শুরু করো’। বাড়িটির হিপনোটাইজিং উপাদান নেই বলেই স্থাপনার প্রতি মনোযোগ স্থির হয় কোনরকম পক্ষপাত ছাড়াই।

একজন স্বনামধন্য শেফ/বাবুর্চি ও তার পরিবারের জন্য এই কৃষিভাব বাড়িটির ডিজাইন করা হয়েছে। একটা গৃহস্থালির ভবন কেমন দেখাতে পারে সেই ধারনাকেই পুরো বদলে দিয়েছে এই বাড়ি। প্রবেশের পথ দেখলে মনে হবে কোন আর্ট গ্যালারি বা থিয়েটার হলে ঢুকতে হচ্ছে যেন। অথচ দরজাটা দেখা যায় মেটাল দেয়ালের একটা জোড়াকে গায়েব করে একটা সরু অথচ ভীষণ লম্বাটে জায়গা তৈরি হয়েছে যা একটি আবাসিক ভবনে দেখাই যায় না। স্থাপতি এই উপত্যকাকে মাটির সাধারণ স্তর থেকে কিছু কিছু জায়গায় নিচে নেমেছেন এবং বেশিরভাগ জায়গাতেই সমতলে থেকেছেন ফলে বাইরে থেকে উচ্চতার দিক থেকে কোন তারতম্য চোখে পড়ে না

পুরো বাড়িটা কতগুলো বিচ্ছিন্ন নানা আকারের বাক্সে সাজানো। সেগুলোর মাঝে একটা ব্রিজ দিয়ে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। তাদেরকে ভারসাম্য দিয়েছে চারপাশের বাহ্যিক পরিস্থিতি। বাড়িটির দুই প্রান্তে বেডরুম, মাঝখানে লিভিং স্পেস আর রান্নাঘর আছে। বাড়িরর কেন্দ্রে একটা লিফটের দেখা মেলে। এই হলো অতি সাধারণ সহজ একটা জোনিং ভাবনা।

একটি অন্ধকার সরু পথ দিয়ে প্রবেশ করার সময় বাড়িটি একটা রহস্যের সৃষ্টি করে। কোথায় আছি আর কোথায় যেতে চলেছি সে সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যায় না। এই সরু আবদ্ধ পথটা এসে মিলে যায় একটা বিশাল আলোকিত পাহারের দৃশ্য সম্বলিত ফাঁকা স্থানে। জায়গাটি পুরোটা খুলে এসে বাইরের সবুজাভ জলাধারের মাঝে পাহাড়ি উপত্যকার একটি অংশের সাথে মিলিত হয়। এই যে সরু অন্ধকার থেকে এসে বিস্তৃত আলোকিত প্রাকৃতিক উন্মুক্ততা এইরকম চিন্তা নিয়ে শিক্ষাজীবনে আমরা কতই না কাজ করেছি।

এই দৃশ্যের সামনে দাঁড়ালের মস্তিষ্ক তার সমস্ত কথা থামিয়ে দেয়, তখন শুধুই হৃদয়ের কথার সুর বয়ে চলে। বাড়ির এই খোলা প্রান্তটি কৃষিভূমির সাথে সংযুক্ত। বাড়ির সাথে লাগানো জলাধারে গরু ছাগল এসে পানি খেয়ে যায়। বাড়িটির শান্তিময় নিস্তব্ধতা তার স্থাপনার সাথে একেবারে মিশে যায়। এটি কোন শীতল গাম্ভীর্য নয় যা দূরে ঠেলে দেয় বরং এক সহজের গাম্ভীর্য যাকে অনুধাবন করতে হয় বলা চলে একটি জীবন্ত মানুষের মতই। দেখতে মিনিমালিস্ট হলেও জীবনাচারের গতিকে কিন্তু এই বাড়ি কোথাও আটকে দিচ্ছে না। সরু ব্রীজের দুপাশ দিয়ে আছে বিশাল বিশাল স্টোরেজ যা খুবই জরুরী। কারণ স্টোরেজে সাময়িক দরকারি জিনিসপত্র মজুদ থাকে বলে অন্য স্পেসগুলো দম নিতে পারে। কোথাও অন্ধকার কোথাও কিছুটা আলো এভাবে যে একটা খেলা এই বাড়িতে ক্রমশ চলতে থাকে তাতে করে মনে হয় আহা সব বাড়িই যদি মেটালের হতো! অথচ এটা একেবারেই নতুন বা বলা ভালো অদরকারি একটি চিন্তা যে মেটাল দিয়ে বসতভিটা বানানো হবে। মেটালের আধিপত্য এতটা জোরালো অন্দরসজ্জায় যে দিব্বি সহজের সৌন্দর্যকে অনুভব করা যায়। কতগুলো সারিবদ্ধ মেটালের ফালি দিয়ে যেমন দেয়াল তৈরি তেমনি এই এক একটা ফালি সরিয়ে দিলেই পিছনে রয়েছে চমৎকার নানা ফাংশন। মেটালের সাথে মিলিয়ে ভবনের অল্প কিছু ফার্নিচার চয়ন করা হয়েছে তারা একে অপরের জন্য যুতসই। সলিড আর ভয়েডের সমন্বয়ে তৈরি এই ঘরের বৈশিষ্ট্য হলো আবদ্ধ ঘরের ধারণাকেও এই বাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে ভয়েডের মাঝে অর্থাৎ শূণ্যতার মাঝে সে জীবন দিতে পারছে। বেডরুম বা লিভিং রুমে কোথাও এক্সপোজড ফার্নিচার নেই। সবকিছুই দেয়ালে বা সিঁড়িতে বা মেঝেতে মিলে থাকে। দরকার মত তাদের ব্যবহার করে নিলেই হয়।
স্থপতির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো কোন ভাবনার ভিত্তিতে স্টিলকে উনি একমাত্র মেটাল হিসেবে নিলেন যেটি পুরো পরিবারকে এক করে ফেলল। স্থপতির মতে, স্টিল আমাদের যেমন সমসাময়িক হতে সাহায্য করে একইভাবে স্টিলের মরচে লম্বা সময় ধরে একটা যাত্রার কথা বলে যেন সে একটা গোটা জীবন দেখে এসেছে। সে হিসেবে বলতে গেলে সময়ের নানা অধ্যায়ের ধারাকে আমরা ম্যাটেরিয়াল হিসেবে নিয়েছি। আমার ক্লায়েন্টের ইচ্ছে ছিলো ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি যেন সে থাকতে পারে তাই প্রকৃতির সাথে নাটকীয়তার চিন্তাটি সেখান থেকেই এলো। পিছনে ফেলে আসা সময়ের সাথে প্রবাহমান সময়ের একটা সংবেদনশীল সম্পর্ক স্থাপিত করা অবশেষে সম্ভব হলো ।
শেফ/বাবুর্চি ফিনা এখানে তার দুই কন্যা ও স্বামীর সাথে থাকেন। তার নিজের সবজি বাগান আছে এখানে, আরো আছে মুরগীর খামার। তার রেস্তরাঁর খাবারের সবজির যোগানও এখান থেকেই হয়ে যায়। সতেজ খাবারের জন্য তার সবসময় চাহিদা থাকে বলেই নিজের বাগান ছাড়া তার চলে না।

স্টিলের নিজেস্ব রঙের মাঝে যে উষ্ণতা আছে সেটা এই শীতপ্রধান এলাকার ক্ষেত্রে উষ্ণতা ভাব জাগাতে সাহায্য করেছে। জলাধারের পানির প্রতিফলন দেখা যায় উপরের ছাদের মেটালে। স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন মাত্রার উচ্চতা ও পরিধির স্পেস, মাটির নিচের অংশে ঘর যেটা বোঝার উপার নেই কিন্তু এই কারণেই রাস্তার গাড়ি বা অন্যকিছু মনোযোগ কেড়ে নেয় না, বাড়ির সাথের সতেজ বাগানের নিজ হাতে লাগানো সবজি, যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা নিশ্চুপ বসে থেকে পার করে দেওয়া যায়… মোট কথা ছুটি কাটানোর জায়গার বিশেষত্বগুলো নিজের বাড়িতে থাকলে তবেইনা কর্মঠ একটা মানসিকতা আর শরীর তৈরি হবে। নিছক বড় স্টিল বাক্স নয়, অব্যক্ত কিছু অনুভূতির মিশ্রণ প্রকাশ পায় এর নানাদিক।

পুরোটা পাওয়া যাবে কয়েকদিন পর!




No comments

Powered by Blogger.