করোনার ঝুঁকিতে স্থাপত্যপেশা এবং যা করণীয়-মো. নাফিজুর রহমান


বাংলাদেশে স্থাপত্য চর্চা প্রাচীনকাল থেকে হয়ে এলেও পেশা হিসেবে আধুনিক স্থাপত্যের গোড়া পত্তন হয়েছে প্রয়াত স্থাপত্যআচার্য মাজহারুল ইসলামের হাত ধরে। ১৯৬৫ শালে আহাসানউল্লাহ প্রকৌশল কলেজ যা বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রদানের শুরু হয় এবং বর্তমানে প্রায় ২৬ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যে স্নাতক ও বিভিন্ন পলিটেকনিক কলেজে স্থাপত্যে ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে যা নির্মাণখাতে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করছে। এছাড়া নির্মাণখাতে প্রায় ২৪ লাখ জনশক্তি সম্পৃক্ত আছে।  এ খাতটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জিডিপির প্রায় ২০ ভাগ অবদান রাখছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হওয়ায় অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী সরকারি খাতে বৃহৎ প্রকল্প ও ভবন নির্মাণ বৃদ্ধি পেয়েছে একই সঙ্গে বেসরকারি খাতেও উল্লেখযোগ্য পরিমানে নির্মাণ কাজ চলছে। সাম্প্রতিককালের (COVID-19) করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অনেকটা হঠাৎ করেই অন্যান্য খাতের মত এই স্থাপত্য ও নির্মাণ খাতটিও আজ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

এ করোনা পরিস্থিতিতে তরুণ পেশাজীবী স্থপতিদের পেশাগত অবস্থার একটি সার্ভে করে দেখা গেছে যে,  এ পরিস্থিতি সহসা সমাধান হলেও ৪০-৫০ ভাগ স্থাপত্য পরামর্শ প্রতিষ্ঠান স্বল্পমেয়াদেই বন্ধ  হয়ে যেতে পারে এবং  আগামী ৬ মাসের অধিক কাল চলমান থাকলে প্রায় ৭০-৮০ ভাগ খুদ্র ও মাঝারি আকারের স্থাপত্য পরামর্শ প্রতিষ্ঠান  পরবর্তী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে এবং এ খাতে কর্মরত স্থপতি , ডিপ্লোমা স্থপতি, প্রকৌশলী সহ অনেক সহায়ক কর্মী  ও তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবার আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে:

১. স্থাপত্য পরামর্শ প্রতিষ্ঠানে জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা এখন সময়ের দাবি। তবে আশার কথা, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সদস্যরা এরই মধ্যে তাদের নিজ উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত স্থপতিদের স্বল্পমেয়াদে সুদমুক্ত ঋণ দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে প্রয়োজন ও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের প্রায় ২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বা স্বল্পসুদে মধ্যমেয়াদি ঋণ প্রকল্প যোগ করতে পারলে তা প্রাথমিক পর্যায়ের দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

২. এরই মধ্যে যেসব অফিস/স্থাপত্য পরামর্শ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, অফিস ভাড়ার ওভারহেডের কারণে ছেড়ে দিতে হয়েছে বা হচ্ছে; স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের আওতায় যেসব অফিসের বড় এবং অব্যবহৃত জায়গা আছে তা অন্যকে  খুদ্র অফিসের সঙ্গে শেয়ার করলে ওভারহেড কমানো যাবে । সম্প্রতিককালে ঢাকা শহরের প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক ‘শেয়ারড অফিস’ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এ করোনাকালীন আপদ মোকাবেলায় ছোট আকারের অফিসগুলো একসঙ্গে একটি অফিস স্পেস ভাড়া নিলে ওভারহেড সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে। কেননা করোনা পরবর্তী সময়ে হোম অফিস ও আউট সোর্সিং জনপ্রিয়তা পেতে পারে।

৩. বাংলাদেশের স্থাপত্য পেশা অনেকাংশেই বেসরকারি খাতনির্ভর এবং করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বেসরকারি খাত নির্মাণের মত ব্যয়বহুল কাজে আগ্রহী হবে না। বিধায় আগামী  এক বছরে বেসরকারি খাতে নতুন কাজের সম্ভাবনাও কমে যেতে পারে। অপরদিকে সরকারি অনেক বড় বড় ভবনের নকশা প্রণয়নের কাজ সরকারি প্রতিষ্ঠান বা স্থাপত্য অধিদপ্তর করে থাকে এতে সরকারে কিছু ব্যয় সাশ্রয় হয়, তবে যা মূল প্রকল্প ব্যয়ের খুবই সামান্য অংশ। সরকারি কাজের একটি অংশ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচন করে তা নির্বাচিত স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের মাধম্য নকশা প্রণয়নের সুযোগ সৃষ্টি করলে তা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্থপতি ও এ খাত সংশ্লিষ্ট সবার কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

৪. দেশের সব পৌরসভা এলাকাতে ভবনের নকশা অনুমোদন ও নির্মাণকাজ তদারকির জন্য দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে সর্বত্র বৃহৎ আকারে নির্মাণ কাজ হচ্ছে। এ নির্মাণকাজ বিধি অনুযায়ী যথাযথভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রতিটি ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভায় একজন স্থপতি নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ। অধিক পরিমান খাদ্য উৎপাদন এখন সরাকারের বড় একটি লক্ষ্য, এ লক্ষ্য অর্জনে আমাদের কৃষিজমির ব্যবহার পরিবর্তন রোধ করতে হবে এবং সমগ্র দেশের জন্য জরুরিভিত্তিতে রুরাল প্লান প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নে প্রতিটি উপজেলায় একজন করে উপজেলা স্থপতি নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এছাড়া পৌর এলাকার বাইরের নির্মাণ অনুমোদন ও তদারকির জন্য ৬৪ টি জেলা পরিষদে স্থপতি নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে। যা সামগ্রিকভাবে নির্মাণ খাতে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক রাখতে হবে।

৫. বর্তমান সময়ে স্থাপত্য চর্চার বড় অন্তরায় মাত্রাতিরিক্ত ভ্যাট ও ট্যাক্স। যেখানে ভবন নির্মাণকরী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে মাত্র ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট  এবং চুক্তি ভেদে ১-৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয় । কোনো ভবন নির্মাণে তার সিংহভাগ অর্থব্যয় হয় । সাধারণত, কোনো ভবনের পরামর্শ ফি নির্মাণ ব্যয়ের ৫ শতাংশ হয়ে থাকে যা খুবই সামান্য কিন্তু এই সামান্য পরিমান ডিজাইন বা পরামর্শ ফির  ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ১০-১২ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। এই মাত্রাতিরিক্ত ভ্যাট ট্যাক্সের কারণে অধিকাংশ ক্লায়েন্ট স্থপতিকে তার প্রাপ্য পরামর্শ ফি দিতে চায় না বা ভ্যাট  ফাঁকি দেয়া বা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দেয় । স্থাপত্য পেশাকে টিকিয়ে রাখতে হলে ভ্যাট ট্যাক্সের এই বৈষম্য কমিয়ে নির্মাণ কাজের সমপরিমান নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

৬. করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসা ও বাণিজ্যে মন্দার ঢেউ রিয়েলে এস্টেট সেক্টরকেও আঘাত করেছে। আমদানি নির্ভর ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত  নির্মাণ সামগ্রীর সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে এবং নগদ  অর্থাভাবের কারণে আগামী কয়েক মাস নতুন নির্মাণ কাজ স্তিমিত হবে এবং ফ্ল্যাট/এপার্টমেন্ট বিক্রিতে মন্দাভাব বিরাজ করবে। নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় এরই মধ্যে অধিকাংশ নির্মাণশ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে এবং তাদের পরিবার খাদ্যসহ আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব নির্মাণ কাজকে চালমান ও গতিশীল করতে এবং এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে দীর্ঘমেয়াদে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান কার্যক্রম গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবুজ অর্থায়নের আওতায় প্রায় ২০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল রয়েছে। এ তহবিল থেকে পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী ভবনের জন্য সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ প্রদানের সুবিধা রয়েছে। তবে এ খাত থেকে অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ ও জটিল। এ তহবিল থেকে অর্থছাড় সহজীকরণ করা এবং তহবিলের পরিমান উল্লেখযোগ্য পরিমানে বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাকে পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী ভবন নির্মাণে সরকারের সঙ্গে অংশগ্রহণে আগ্রহী করে তোলা প্রয়োজন। 

আশার কথা, বিগত কয়েক বছরে সরকার তার নানাবিধ পলিসি প্রণয়ন দ্বারা পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী ভবন নির্মাণে উৎসাহ প্রদান করছে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার ব্যবস্থা করছে। করোনা সংকট মোকাবেলায় এ খাতকে আরো গুরুত্ব দিয়ে আরো অধিক প্রণোদনা দিতে হবে। স্থপতিদের সংগঠন বাংলাদশ স্থপতি ইনস্টিটিউট স্থপতিদের পেশাগত দক্ষতাসহ সব ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফলভাবে দারুণ কাজ করছে। তবে এই করোনা পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পেশাজীবী সংগঠন ও সরকারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও সংস্থাকে একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক: মো. নাফিজুর রহমান, স্থপতি ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.