স্থাপত্যের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে যায় ‘স্থাপত্য’ শব্দটিকে জানার আগেই-সুপ্রভা জুঁই||


স্থপতি হওয়ার স্বপ্ন হৃদয়ে নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন। স্থপতি হওয়ার জন্য যা যা যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন সেসব অর্জন করাই হলো মূল লক্ষ্য। এক্ষেত্রে সবার শুরুতেই একজন শিক্ষকের কি শেখানো উচিৎ?
শিক্ষার্থীদের সবকিছুর প্রথমে আমাদের অবশ্যই জানানো জরুরী যে, শিক্ষক বলে যে মানুষটিকে আমরা জানি তিনি এমন কেউ নন যাকে যে প্রশ্নই করা হোক না কেন তিনি তার জবাব জেনে বসে আছেন। কারণ স্থাপত্যচর্চা হলো নিজে থেকে প্রশ্ন করা, সে প্রশ্নের জবাবও নিজেই খুঁজে বের করা কিন্তু শিক্ষকের সহায়তায়। তাদের অগোছালো ভাবনার বিশাল ভা-ারকে গুছিয়ে এনে পথ দেখানোই হলো শিক্ষকের কাজ।
ভালো ডিজাইনের শক্তিটা কিন্তু লুকিয়ে আছে আমাদের সামর্থ্য এবং গোটা বিশ্বকে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখছি তার উপর। সেটা আবেগ এবং যুক্তি এই দু’য়ের উপর ভর করেই। একটি ভালো স্থাপনার ডিজাইন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও সূক্ষ্ম চেতনা সম্পন্ন।
স্থাপত্যের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে যায় ‘স্থাপত্য’ শব্দটিকে জানার আগেই। স্থাপত্য নিয়ে আমাদের বোঝাপড়াটুকু স্থাপনার সাথে আমাদের সম্পর্কের মাঝেই নিহিত। এই যেমন আমাদের ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, গ্রাম-শহর, ল্যান্ডস্কেপ- এর সবই কিন্তু আমাদের স্থাপত্যের সাথে পরিচিত হওয়ার আগেই অসচেতনভাবে আমরা জেনে গেছি। পরবর্তীতে এই অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়লে আমরা নিজ এলাকার অবকাঠামোর সাথে অন্যান্য এলাকার তুলনা করতেও দক্ষ হয়ে উঠি। সেদিক থেকে আরো ভালো করে বলতে গেলে স্থাপত্যের শেকড়টা গেঁথে রয়েছে আমাদের শৈশবে, কৈশোরে, তারুণ্যে, অর্থাৎ গোটা জীবনে। আর ঠিক সেই কারণে শিক্ষার্থীদের স্থাপত্যচর্চার ক্ষেত্রে তাদের জীবনের এই বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলোকে সচেতনতার সাথে ব্যবহার করে কাজ করতে হবে। এই সকল ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা একত্রিত হয়ে স্থাপনার গোটা প্রক্রিয়াকে গতিময় করে তোলে।
আমরা বরং এটা ভাবতে পারি যে এই বাড়ি-ঘর বা শহরের কী এমন জাদু আছে যা আমাদের মনে ছাপ ফেলেছে, স্পর্শ করতে পেরেছে হৃদয়কে এবং কেনই বা পেরেছে! ঘরটা দেখতে কেমন, বর্গাকার কিনা, এখানে থাকার অভিজ্ঞতা কেমন, এখানের বাতাসের ঘ্রাণ কেমন, হাঁটলে পায়ের আওয়াজ কেমন শোনাবে, গলার স্বরই বা শোনাবে কেমন, পায়ের তালুতে ঠিক কিরকম অনুভূতি হবে, কেমন অনুভূতি হবে দরজার হাতলের স্পর্শে, দেয়ালে আলোর ছটা কিরকম দৃশ্যের অবতারণা করবে, সে আলোর প্রতিফলন পড়বে কি? জায়গাটা অনেক সরু নাকি প্রশস্ত, নাকি একটা অন্তরঙ্গ ভাবের সৃষ্টি করে অথবা বিশালতার?
স্থাপত্যবিদ্যা সবসময়ই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, বস্তু সম্পর্কিত। এটা বিমূর্ত কোন ধারণা নয় বরং অনুভবযোগ্য। কাগজে আঁকা কোন প্রকল্পের দ্বিমাত্রিক প্ল্যানও স্থাপত্য নয়। এটা হলো স্থাপনার ক্ষেত্রে বিবেচিত মাপকাঠিতে কখনো উপরে আবার কখনো নিচে থাকা মূল কাঠামোর একটা উপস্থাপন। ব্যাপারটা সঙ্গীতকে কাগজে প্রকাশ করলে যেমন হয় ঠিক সেরকম। সঙ্গীত শব্দের মধ্য দিয়ে প্রকাশ হওয়ার দাবি রাখে। তেমনি করে স্থাপত্যেরও দাবি আছে ত্রিমাত্রিক হওয়ার। কেবল তখনই তা একটা দেহ ধারণ করে বস্তুজগতের অংশ হয়। এই দেহটি সর্বদাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য।
সব ডিজাইনের শুরুটাই হয় এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্থাপনার ম্যাটেরিয়ালের মধ্য দিয়ে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপায়ে স্থাপত্যের অভিজ্ঞতা লাভের অর্থ হলো তাকে স্পর্শ করে, দেখে-শুনে, ঘ্রাণ নেয়ার মাধ্যমে পরিচিত হওয়া। এই সমস্ত যোগ্যতার বলে স্থাপনাকে আবিষ্কার করার পদ্ধতিটাই হলো আমাদের স্থাপত্য শিক্ষাদানের মূল বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.