Thursday, May 6, 2021

ইন্ডিয়া পাকিস্তানে ষাটের দশকে এত এত আর্কিটেক্ট আমদানী করা হইলো কেন?


 ইন্ডিয়া পাকিস্তানে ষাটের দশকে এত এত আর্কিটেক্ট আমদানী করা হইলো কেন? উত্তর৷ আলোচনা।

-


একটা রাষ্ট্র আসলে কি? রাষ্ট্র কিভাবে বাস্তবায়িত হয়? কিভাবে একটি রাষ্ট্র- একটি আইডিয়া থেকে একটি সিস্টেম হয়ে ওঠে?


রাষ্ট্রের গুণগত গঠন নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। বরং, যে দিকটা নিয়ে আলাপে আমি বেশি আগ্রহী- সেটা হল, আইডিয়া বাস্তবায়ন হইতে তার একটা ভৌত কাঠামো দরকার হয়৷ যেমন, আপনি বলতে পারেন, আপনি ধর্মে বিশ্বাস করেন৷ এবং, আমরা জানি কোনো ধর্মের ঈশ্বরই দুনিয়াতে বসবাস করেনা। তাহলে, ঈশ্বর বাস্তবায়িত হয় কেমনে? ঈশ্বর বাস্তবায়িত হন- রিচুয়ালের মাধ্যমে। বিশ্বাসীদের প্রতিদিনকার এক্টিভিটিজএ। আর, এই বিশ্বাসীদের কে সামগ্রিকভাবে- গোষ্টী হিসেবে আচরন করার জন্য, একটি সামাজিক আচরনের ভৌত কাঠামো হিসেবে প্রয়োজন হয় ধর্মীয় স্খাপনার। চার্চ, মসজিদ, টেম্পল, গোরস্থানের। এইভাবেই- একটি আইডিয়া বাস্তবায়িত হয়।


পোস্ট কলোনিয়াল পিরিয়ড নামে, যেই পিরিয়ডকে- আমরা কয়েন করি- সেটা মূলত পোস্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ার পিরিয়ড। খেয়াল করবেন, মূলত বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই- ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন- একটা প্রচণ্ড গতিময়তায় প্রবেশ করার সময় থেকেই, প্রচন্ড রকমের প্রয়োজন হয়ে পড়ে সুসংহত রাষ্ট্র। কেননা, সুসংহত গোছানো- রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো ব্যতীত- এই নতুন উন্নয়ন মডেল বাস্তবায়ন কোনোমতেই সম্ভব ছিলো না। এবং, এই কাঠামোকে বাস্তবায়িত হইতে গেলে- প্রয়োজন হয়, পরিপূরক ভৌত কাঠামো। ধরেন, পূজা বাস্তবায়নে যেমন, পরিপূরক টেম্পল দরকার- তেমনই, রাষ্ট্র- একটা বিমূর্ত ধারনাকে বাস্তবায়িত করতেও পরিপূরক ভৌত কাঠামো অপরিহার্য হয়ে দাঁঁড়ায়।


তখনই, দেখবেন- সারা দুনিয়াতে, সামাজিক ভৌত কাঠামো নির্মাণ তত্ত্বে কিছু Radical পরিবর্তন আসা শুরু হয়। অনেকগুলো- মতবাদকে পাশ কাটিয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে " Modernism" বা, অধুনাবাদ। 

মডার্নিজম - কে, শুধুমাত্র- ক্যাপিটালিস্ট বলে আমি মনে করি না। বরং, মনে করি- এটা খুবই প্রশাসনিক। প্রাথমিকভাবে, এর লক্ষ্য ছিলো- রাষ্ট্রকে সুসংহত করা। রাষ্ট্রের কোর্ট - সেক্রেটারিয়েট- পার্লামেন্ট এগুলাকে। 

এবং, খেয়াল করবেন, এই মডার্নিজমের জন্ম হয় হিটলারের জার্মানীতে। প্রবাহিত হয় সমগ্র ইউরোপে,  বিকাশ লাভ করে আমেরিকায়- ত্বরিৎ ছড়িয়ে পড়ে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ গুলোতে, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ- ভারত পাকিস্তান।


ভারত স্বাধীন হবার পূর্বেই সেখানকার প্রশাসনিক কাঠামোকে, শক্ত রুপ দেবার জন্য একদল- আর্কিটেক্ট, আর্টিস্ট, টাউন প্ল্যানার কাজ শুরু করেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একদিক থেকে জনগণকে নিয়ন্ত্রণের কাজ, আরেকদিক থেকে- রাষ্ট্রের চাওয়া অনুযায়ী জনগণকে দেখবার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা নির্ধারন ছিলো এই বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার প্রধান এজেন্ডা। তার ধারাবাহিকতায়, ভারতের স্বাধীনতার ঘটনা অনেকাংশই আকস্মিক। এবং, তাতে- "সুসংহত রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক কাঠামো" যে, আইডিয়া, সেটা পরিপূর্ণতা লাভের পূর্বেই- ভারত পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে পড়ে। 


এই আকস্মিক স্বাধীনতাকে রক্ষা, নিজেদের প্রশাসনিক তৎপরতাকে ধারাবাহিক রাখা এর জন্য- নিজস্ব ভাষা বিনির্মানের উদ্যোগ আপনি দেখবেন খুবই অনুপস্থিত, সম্পূর্ণ ইতিহাসে। ভারত কিংবা, পাকিস্তান কোনো নতুন রাষ্ট্রধারনাকে জন্ম দেয়নি। বরং, যা করেছে- তা হল, বুদ্ধিবৃত্তিক আমদানী। উপমহাদেশের স্বাধীনতাকে আপনি শেষমেষ কোনো অর্জন বলতে পারেন না। এর সংগ্রাম ইতিহাস দীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু, সেই সংগ্রাম ইতিহাস- শেষমেষ, পাশ্চাত্য রাষ্ট্রব্যবস্থারই অন্ধ অনুকরণের সিদ্ধান্তই। এটা প্রাচ্যের মৌলিক কিছু নয়।


আর, পশ্চিমের এই রাষ্ট্রগুলোর সবচে, গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এর নিয়ন্ত্রনধর্মীতা।


আপনি নিশ্চয়, যিশুখ্রিস্টের পূজা মসজিদে করতে পারবেন না! মানে, আপনার তো অই- জায়গাগুলাই নাই। যিশুরে টাঙানোর যায়গা, ব্যাপটিজমের বালতি - একইরকম, আপনি কি পশ্চিমের রাষ্ট্রকে- হুট করে, ভারতে /পাকিস্তানে বাস্তবায়িত করতে পারবেন? এই অশিক্ষিতদের আগে- আপনার পশ্চিমা ধাঁচে পড়ানো লাগবে, আপনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বানানো লাগবে। আপনার লাগবে সেক্রেটারিয়েট- আপনি যদি আমলাদের ক্ষমতায়ন চান। এই বর্বরদের যদি আপনি ডেমোক্রেসি বুঝাইতে চান, যেই ডেমোক্রেসি মূলত আধিপত্যবাদী ডেমোক্রেসি- যারে অমান্য করা যায় না- এমন দর্শনের ডেমোক্রেসির জন্য আপনার লাগবে বিকট দর্শন নয়তলা পার্লামেন্ট। আপনার পুরা ব্যবস্থা- ফাংশান করানোর জন্য লাগবে, পরিপূরক হাউজিং স্টেট- শেরেবাংলা নগর কিংবা, আহমেদাবাদ।


উপনিবেশ স্বাধীন হবার পর, সবচে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিলো- রাষ্ট্র সুসংহত করার যুদ্ধ। প্রশাসনরে সুসংহত করার যুদ্ধ। আপনি দেখবেন না, এই দেশে হাজার হাজার ডাক্তার আমদানী করা হচ্ছে। আপনি দেখবেন না, এই দেশে কৃষি প্রযুক্তিবিদ হায়ার করা হইতেসে। যেই দেশে, কোনোদিনই কোনো জ্ঞানের মূল্যায়ন হয় নাই, সেই দেশে হুটহাট ধুম করে- গণ্ডায় গণ্ডায় আর্কিটেক্ট আমদানি করা হচ্ছে কেন? কারনটা কি? সমসাময়িক যেকোনো ধারনার চে- ১৯৫০-৬০ এর ভিতর, রাতারাতি শহর, প্রাসাদ্যোপম পার্লামেন্ট বানানোর কারন কি? এর একমাত্র কারন, আমি মনে করি- পশ্চিমের সুসংহত রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে এই দেশে রাতারাতি বাস্তবায়ন। এখন, এই বুদ্ধিবৃত্তিক আমদানীকে আপনি কি কোনোভাবে অর্জন হিসাবে দেখতে চান? বা, আদৌ - এইটা কি " গর্ব" করার মতন কোনো বিষয়? এইখানে- আমাদের ইনোভেশান টা কোথায়? বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট গোষ্ঠী এখনও লুই আই কানের মাস্টারপিস নিয়ে গর্ববোধ করে। বলতে চায়, এত সুন্দর পার্লামেন্ট নাকি সারা দুনিয়ায় কোথাও নাই- আমার প্রশ্ন হল, এই পার্লামেন্ট কি আমাদের অর্জন? পঞ্চায়েত আমাদের লৌকিক ডেমোক্রেসির সবচে পুরাতন ফর্ম- তো সেই পঞ্চায়েতকে বাস্তবায়িত হইতে তো কোনো নয়তলা পার্লামেন্ট লাগেনা। তাহলে, এইযে নিয়ন্ত্রনধর্মী ডেমোক্রেসির চার্চ- আমাদের পার্লামেন্ট, এই পার্লামেন্ট আসলে কার? এই পার্লামেন্টের দরকার পড়লো কেন? হুটহাট ভারত/ পাকিস্তানের মতন তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বে- কেন প্রথম বিশ্বের পার্লামেন্ট দরকার পড়লো?

এই পার্লামেন্টকে এখনও আমি জনগণের পার্লামেন্ট বলতে চাইনা, কিংবা, বলতে পারিনা। এই দেশের জনগণকে শোষণের যাবতীয় আইন ঐ পার্লামেন্টেই পাস হয়। দেশে বিদ্যমান যাবতীয় স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্সের জন্ম- ঐ পার্লামেন্টেই। 


আমি একা যে কথাটা বলছি, তা কিন্তু, না- আমাদের আচার্য মাজহারুল ইসলামও কথাটিকে বলেছেন। তিনি এই রাজনৈতিক অনুসন্ধানে যান নাই। তিনি বলেছেন, চর্চার ভিতরেই- তিনি টের পেয়েছেন, যে আর্কিটেকচারের মাধ্যমে ইউরোপ আমেরিকা আসলে অন্যদের নিয়ন্ত্রন করতে চায়। তিনি অন্য আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন, সেটা হল- ম্যাটেরিয়াল রপ্তানি। মানে, মডার্নিজম বাস্তবায়নের যে- কন্সট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল ঐটাও তো এইদেশে তৈরী হত না তখন। আমদানী করা লাগতো- কনক্রিট, গ্লাস। কিন্তু, আপাতত এই আলাপকে আমার গৌণই লাগে।


এই আলোচনার কনক্লুশান আমি টানতে চাই এইভাবে, ধরেন- এই পাশ্চাত্য সুসংহত নিয়ন্ত্রণবাদী কাঠামোগতভাবে সহিংস এবং, আধিপত্যবাদী- রাষ্ট্রব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামোকে- এই দেশের জনগণের উপর আরোপের উদ্দেশ্যেই এই দেশগুলোতে বিদেশী আর্কিটেক্টদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। এবং, এইসকল ডেভেলপমেন্ট কখনোই জনগণের উন্নয়ন ছিলোনা। এইগুলো নিয়ে সমকালীন স্থপতিদের গর্বকেও আমি খারিজ করি। এবং, একইসাথে- জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের স্থাপত্য কাঠামো কেমন হবে, তা নিয়ে এক দীর্ঘ সংগ্রাম আমাদের এখনও করতে হবে বলে মনে করি। তার জন্য, পয়লা একটা জনকল্যানমূলক রাষ্ট্রনীতি তো লাগবে!


(স.মোহাম্মদ নাহিন রহমান এর Facebook পেজ থেকে সংগ্রহ করা)

No comments:

Post a Comment