মোঃ ওবায়দুল হক
এক_ শুরু করবার আগে প্রথমেই আমাদের দেশে স্থপতি সমাজে কম বেশী সবাই শুনে থাকি এমন কিছু কথা তুলে ধরি।
- (ঠোঁটের কোনে উপহাসের হাসি নিয়ে)
রিসার্চ? ধুর! ওসব করে কি হবে? হা হা হা...
রিসার্চ? ধুর! ওসব করে কি হবে? হা হা হা...
- আরে ধুর সময় নষ্ট। শোন! আর্কিটেকচারে ওসব রিসার্চ ফিসার্চ দিয়ে কিছু হয় না! সব ফিল্ডে নেমে বুঝতে হয়।
- রিসার্চ টিসার্চ হলো আঁতেলদের কাজ। মাস্টারি করতে লাগে, এসব আজাইরা চিন্তা করে লাভ নাই।
- কয়টা পেপার পাব্লিশ হলে কি এমন দুনিয়া উল্টায় যাবে? এসব পেপার টেপার দিয়ে কিছু হয়না। অমুক দেশে দেখবা ওরা পেপারে বিশ্বাসী না। কাজে বিশ্বাসী। তাই আজ কত উন্নত হয়ে গেছে সে দেশ!
পেশায় সফল কিছু মানুষ তো আরো একদাগ বাড়িয়ে মুখে উপহাসের হাসি নিয়ে, ওমুকে যে এত এত রিসার্চ করে বেড়ায় সে কি আর্কিটেকচার এর কিছু জানে? আরে সে তো আরো আর্কিটেকচার ধ্বংস করছে!
দুই_ এবার আসি আমাদের দেশে স্থাপত্যে গবেষণার অবস্থা। কি লিখব এই বিষয়ে। কিছুটা রসিকতা করে লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে, কই কিছুতো খুঁজেই পাচ্ছি না! এই বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে গেলে হাতে গোনা ২/১ টা বিশ্ববিদ্যালয় এর নাম তাও বলাবাহুল্য সেখানে খুব সীমিত সংখ্যা এবং সু্যোগ। তাই একটা বিশাল মেধাবী গবেষক দল চলে যাচ্ছেন বিদেশে।
এর বাহিরে গবেষণা হচ্ছে সরকারি বেসরকারি দুই তিনটি সংস্থায় যাদের কার্যক্রম ব্যাক্তি উদ্যোগ কিছু জানতে গেলেই জানা যায় অল্প কিছু। সকল স্থপতিদের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায় বলে আমার জানা নেই। আমার কানে পৌঁছায় না এটুক বলতে পারি। আর সব মিলিয়ে তাতে গবেষণার পরিবেশ, যথাযথ সরঞ্জাম ও অর্থ সরবরাহ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার চিত্র নাই বা বলি!
তাই সাধারণ দৃষ্টিকোন থেকে বলাই বাহুল্য, ভাল নেই আমাদের দেশে স্থাপত্যে গবেষণা।
তাই সাধারণ দৃষ্টিকোন থেকে বলাই বাহুল্য, ভাল নেই আমাদের দেশে স্থাপত্যে গবেষণা।
তিন_ দুই নাম্বার অনুচ্ছেদ এর অবস্থা বা চালচিত্র যখন আমাদের বাস্তবতা সেখানে অনুচ্ছেদ এক এ যে কথাগুলা তুলে ধরেছি সেটি-ই হওয়াটাই বাস্তবতা। একে অল্পবিদ্যায় ভয়ংকরী বললেও ভুল হবেনা মনে হয়। আমরাই গবেষণা করব না আবার আমরাই গবেষণা নিয়ে উপহাস করব। আবার আমরাই নানান সময় আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং খুঁজে হা হুতাশ করি। কেউ আবার র্যাংকিং এ কয়েক হাজারতম হয়ে আরেক কয়েক হাজারতম থেকে এগিয়ে থেকে গর্ব করতেও দেখি! কি নির্মম রসিকতা।
চার_ আরেকটি ভিন্ন দিক তুলে ধরতে চাই। সেটা হলো, গবেষণা বলতেই সকলের ধারণা হয়তো এই একগাদা বইপত্র নিয়ে অবিরাম পড়তে থাকা, পড়তেই থাকা পড়তেই থাকা। আবার আরেক ধারনা, এই রে! পাব্লিকেশন এর জন্য ওরকম লিখতে হয়? এত এত সিস্টেম, এত এত নিয়ম, এত্ত কঠিন! দরকার নেই বাবা! হয়তো অনেকাংশেই ধারণা সত্যি। আর এই সংক্রান্ত যেকোন কিছুর মাধ্যমই হলো ইংরেজি। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা আমাদের দেশে এখনো পরিসর খুব বেশী নয়, সেখানে একাডেমিক রাইটিং, ক্রিটিকাল রাইটিং এর অবস্থা ডিগ্রীধারীদের বেলাতেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সন্তোষজনক নয়।
এমনিতেই স্থাপত্যে পড়াশুনা একেবারেই অন্যসব ডিসিপ্লিন থেকে আলাদা। আর ব্যচেলর করতে হয় ৫ বছরের এক অস্বাভাবিক কষ্টের মধ্য দিয়ে। সচরাচর স্বাভাবিক ক্লাসরুম, জীবনধারা এখানে অস্বাভাবিক। স্টুডিও ওরিয়েন্টেড কাজেই স্থাপত্যের শিক্ষক - শিক্ষার্থীরা বেশী কম্ফোর্টেবল। তাই আর সব সিস্টেম যখন স্থাপত্যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে চালিত সেখানে গবেষণার ক্ষেত্রে চলতে হয় অন্য সব ডিসিপ্লিন এর মত করেই। অন্যদের যেকোন কাজ পাব্লিকেশন এর জন্য যেভাবে তৈরি করতে পারে একটা স্থাপত্যকে চাইলেই সেভাবে করা যায় না। ডিজাইন এবং রিসার্চ দুটো আলাদা জিনিস। এমনকি শিক্ষকতায় যারা আছেন তাদের বেলাতেও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অন্য ডিসিপ্লিনের মত করে পাব্লিকেশন সংখ্যা লাগে, কোন স্থাপত্যকর্ম এখানে কাউন্ট করা হয় না!
এই ব্যাপারগুলোর জন্যেও স্থাপত্যে গবেষণায় কেবল নিরুৎসাহিত হবার রসদই স্থপতিরা খুঁজে পান বলে আমার ধারনা।
পাঁচ_ তো এই যখন অবস্থা তখন করনীয় কি?
আমার হয়তো যোগ্যতাই নাই এসব বলবার। সেখানে সমাধান এর দৃষ্ঠতা কি করে দেখাই? সমস্যা অনেক। সেটা চিরকালই থাকবে। সমস্যা সমাধান করে কিছু সাফল্য পেলে আবার নতুন সমস্যা আসবে।
তবু স্বল্প জ্ঞ্যনে যেটুকু বুঝি তা হলো, সবার আগে দৃষ্টিভংগী বদলাতে হবে। স্থাপত্যের গবেষণা পদ্ধতি চাইলেই ইউনিক করে ফেলা যাবে না। মাধ্যম বদলে ফেলা যাবেনা রাতারাতি। তবে সেটা শুরু করতে হবে। কেউ কেউ শুরু করেছেন বা করতে চাইছেন তাদের উপহাস না করে, পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু পাব্লিকেশন এর চিন্তা থেকে নয় স্বতঃস্ফূর্ত গবেষণার দিকে মনোযোগ দিতে হবে,যিনি পাব্লিকেশন ভাল বোঝেন তার মাধ্যমে পরে পাব্লিশ এর চিন্তা। কন্টেক্সট বুঝে ছোট ছোট রিসার্চ দিয়েই স্বল্প খরচে শুরু করা যেতে পারে। প্রথমেই বড় কিছু, বিদেশী কিছু দেখে আমাদের হবে না হবে না করলে কখনোই হবেনা। পেশায় সফল যারা তাদের এগিয়ে আসতে হবে।
যেই যায়গাগুলো শুধু সচেতনতা তৈরি করেই করা সম্ভব সেই জায়গাগুলোতে যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে। শিক্ষা পদ্ধতি, কারিকুলামেই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে হবে, শিক্ষার্থীদের উৎসাহী করতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা রেখে একসাথে নানাবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। ইন্সটিটিউট অবদান রাখতে পারে নানাভাবে। যেখানে যারা উচ্চাসনে আছেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে তাদের অবদান রাখতে হবে।
করার আছে কতকিছুই। কিন্তু এসবই হয়তো স্বপ্ন! কিছু হবে কি হবে না, কেউ করবে কি করবে না জানি না। নাকি প্রথম অনুচ্ছেদের বুলিগুলোই কেবল শুনে যাব কে জানে! তবু লিখে রাখলাম যা যা মনে লালন করছি।
কেন? কি দরকার? একটা লাইন দিয়েই শেষ করব। অনেকেই শুনেছেন হয়তো;
"Architect shapes the society and
research shapes the Architect"
ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment