Monday, April 27, 2020

মূঘল সেতুর সন্ধানে

পর্ব- ০১: মিরকাদিমের সেতু

মিরকাদিম সেতুর দৃশ্য

ভ্রমণ কথাঃ
অল্প সময়ের মধ্যেই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়ে যায় রাতুল আর ইফতির । এর মূল কারণ হয়ত তাদের চিন্তা ধারার মিল। দুইজনেই ভ্রমণপিপাসু আবার দুইজনেই এমন সব জায়াগায় ভ্রমণ করতে পছন্দ করে যেসব জায়গার ঐতিহাসিক কোন অর্থ আছে । রাতুল এর টান এসব ঐতিহাসিক জায়গা গুলোর স্থাপত্য নিয়ে ভাবে তো ইফতি চেষ্টা করে সেসময়টা অনুভব করার যখন এই স্থাপনা গুলো তৈরি করা হয়েছিল। অবশ্য দুজনই স্থাপত্যের ছাত্র হওয়ায় ভ্রমণ তাদের জন্য ছিল আসলে এক ধরনের আসক্তি। সেই সুবাদেই দুজন মিলে চলে গেল মুন্সীগঞ্জ। উদ্দেশ্য ছিল ঐতিহাসিক স্থান সমূহ ঘুরে দেখা। এর মধ্যে রাতুল বের করে ফেললো তাদের আসলে একটা মূঘল ঐতিহাসিক সেতু আছে সেটা ঘুরে দেখা উচীত, কারণ এর সম্পর্কে যথেষ্ঠ ইতিহাস তার জানা। আর ইফতি তাতেই রাজি। কারণ ইফতি তো চায়ই সময় টা অনুভব করতে আর সেই মূঘল সেতুর ইতিহাস সম্পর্কে রাতুল এর জানা তাই সময় টা অনুভব করতে কোন সমস্যাই থাকলো না। কথা শুরু হলো সেই মূঘল সেতু নিয়ে যার নাম মিরকাদিমের পুল বা সেতু যার স্থানীয় নাম পুলঘাটা সেতু বা ব্রীজ।

পূর্বভাষ : : শুরুর দিকে


হিন্দু পুরানের রাজা বিক্রমাদিত্য' নামানুসারে প্রাচীন বিক্রমপুরের নামকরণ তবে এতদ অঞ্চলে শাসক একজন নয়, বেশ কয়েকজন শাসক ছিলেন তাদের মধ্যে  চন্দ্রগুপ্ত, ধর্মপাল, সম্রাট হেমু প্রমুখ রাজাগণ এই নামটিকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন অতীত ঐতিহ্য,রাজা-রাজরাদের শৌর্য -বীর্য নিয়ে শক্তপোক্ত অবস্থানে গড়ে উঠা এই প্রাচীন নগরী এই নগরীতে গড়ে উঠেছিল বহুমুখী স্থাপনা এসব স্থাপনার কোন কোনটি এখনো টিকে রয়েছে আবার কোনটি হারিয়ে গাছে কালের অতল গহ্বরে বহু সময় পার হয়েছে একটা বিস্তর ক্রান্তিলগ্নের মধ্য দিয়ে পৌঁছানোর পরে বিক্রমপুর নামটি অনেকটাই চাপা পরে যায় এই অঞ্চলের নেই কোন প্রশাসনিক স্বীকৃতি তবে, বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার একটি বিস্তৃত অংশের মানুষজন নিজেদের ঐতিহাসিক বিক্রমপুরের অধিবাসী বলে দাবি করে এই বিক্রমপুর পরগনার এক ঐতিহাসিক স্থাপনা মিরকাদিমের সেতু যদিও তালতলা সেতুটি টিকে থাকলে বিক্রমপুরে দুইটা সেতু থাকতো


মিরকাদিমের সেতুর অবস্থান  

মুন্সীগঞ্জের (প্রাচীন বিক্রমপুর) টঙ্গীবাড়ী উপজিলার রামপাল থানার পুলঘাটা গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক স্থাপনা মিরকাদিমের সেতু পানাম সেতুর ন্যায় দেখতে তাই, এই সেতুর অপর নাম "পানাম -পুলঘাটা" সেতু আবার অনেকেই এই সেতুকে "পুলঘাটা সেতু" নামে ডাকে স্থানীয় লোকজনের মতে, এই সেতুর নাম "গায়েবি সেতু" বা, "গায়েবানা সেতু" একটি কল্পিত মিথ বা জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে তারা এই সেতুর নামকরণ করেন তবে যে নামেতেই ডাকা হউক না কেন, এটি যে একটি প্রাচীন সেতু সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই মিরকাদিম সেতুর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মিরকাদিম খাল  প্রাচীন এই খাল পানাম পুলঘাটা আব্দুল্লাপুর গ্রামকে সংযুক্ত করেছে

মিরকাদিমের সেতুকে ঘিরে প্রচলিত মিথ বা, জনশ্রুতি
 
মিরকাদিমের সেতু নিয়ে বহুল মিথ প্রচলিত রয়েছে এই অঞ্চলে স্থানীয় জনগণ বিশ্বাস করেন এই প্রাচীন সেতু মানুষের হাতে তৈরী হতে পারে না সেতুটি জ্বীন -পরীদের হাতে তৈরী জ্বীন -পরীদের বহুল পরিশ্রমের এক রাতের ফসল এই সেতু গায়েবীভাবে তৈরী হয়েছে সেতু যেখানে মানুষের চোখে সেতু গড়ে উঠতে দেখা যায়, কিন্তু অদৃশ্য সত্তাকে চোখে দেখা যায় না এইসব মিথ বা জনশ্রুতি প্রচলিত গল্প বৈকি কিছুই নয় তবুও এই মিথ বা জনশ্রুতি বেঁচে থাকবে আজীবন প্রাচীন স্থাপনার ইতিহাসের সাথে এই সব মিথ বা জনশ্রুতি আলিঙ্গন করে থাকে চিরকাল
মিরকাদিম সেতুর দৃশ্য


মিরকাদিমের সেতুর নির্মাণকাল,নির্মাতা ইতিহাস
মুঘলদের হাত ধরে এই বাংলায় বহুমুখী স্থাপনা গড়ে তোলা হয় তার মধ্যে একটি হল, এই সেতু স্থাপনা সুলতানি আমলে এই বাংলায় সেতু স্থাপনা গড়ে উঠার কোন ইতিহাস নেই যা কিছু আছে সব মুঘল আমলে
মুঘল আমলে নির্মিত মিরকাদিমের সেতু এই সেতুর নির্মাণকাল ১৬৫৮ থেকে ১৬৬০ সালের মধ্যে বলে ধারণা করা হয় এই সেতুর নির্মাতা ছিলেন মীর জুমলা (১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দ - ১৬৬৩খ্রিষ্টাব্দ) মুঘল শাসন আমলে এতদ অঞ্চলের সুবাদার ছিলেন মীর জুমলা ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জলদুর্গ নির্মাণের পাশাপাশি এই সেতু নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর  রাজত্ব কালে ইদ্রাকপুর কেল্লা হতে দোহারে অবস্থিত মুসা খানের কেল্লা পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্যে সুবাদার মীরজুমলা দুইটা সেতু নির্মাণ করেনতার মধ্যে একটি "মিরকাদিম সেতু", অপরটি "তালতলা সেতু" দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজদের বোমার আঘাতে এই "তালতলা সেতু"টি উড়িয়ে দেয়া হয় সেতুটি তখনি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় যা কিছু অবশিষ্ট গল্প সব পাওয়া যায় পুরানো নথি, বই ইতিহাসে আবার লোকেদের মুখে মুখেও এই সেতুর গল্প জানা যায়
অবশিষ্ট টিকে রইলো মিরকাদিমের সেতু মিরকাদিম সেতু এখনো অক্ষত আছে তবে এই সেতুর নির্মাণ সম্পর্কিত কোন শিলালিপি নেই সেতুর স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে মুঘল আমলের স্থাপনা বলে ধরে নেওয়া হয়




প্রাচীন সেতু' গাঠনিক বৈশিষ্ট্য স্ট্রাকচার ভাবনা


সেতুর নকশা 

মুঘল সেতুর প্ল্যান . উদাহরণ - মিরকাদিম সেতু

মিরকাদিম সেতুর "প্ল্যান" বা, "নকশা" সরলরৈখিক দীর্ঘ আকৃতির "প্রস্থ" অপেক্ষাকৃত কম, দৈর্ঘ্য অনেক বেশি সেতুর মধ্যবিন্দু 'তে অর্থাৎ কেন্দ্রস্থল একটু উঁচু সেতুর উপরিভাগ থেকে ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে সেতুর "প্ল্যান " বা "নকশা" তে খিলানের পিলার এর অস্তিত্ব দেখা যায়
সেতুর এলিভেশন 
মুঘল সেতুর সম্মুখ এলিভেশন : : উদাহরণ - মিরকাদিম সেতু



মুঘল সেতুর সম্মুখ এলিভেশন : : উদাহরণ - মিরকাদিম সেতু


মিরকাদিম সেতুর স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
 
ঐতিহাসিক পানাম নগরী সংলগ্ন "পানাম সেতু", চাপাতলী গ্রামে অবস্থিত "ইটের পুল" আর "মীর কাদিমের সেতু" যেন একই সূত্রে গাঁথাতিনটা সেতু দেখতে অবিকল একটার ন্যায় আরেকটা স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়েও তাদের মধ্যে বহু মিল



*      চুন-সুরকি ইট দিয়ে নির্মিত এই ঐতিহাসিক সেতু সেতুর সম্পূর্ণটাই ইটের পলেস্তরা আস্তরণ করা নেই কোন কষ্টি পাথরের অস্তিত্ব
*      বহুল পুরুত্ব বিশিষ্ট এই সেতুর আর পুরুত্ব ফুট ইঞ্চি বিশেষত সেই সময়ে কলাম স্ট্রাকচার এর ব্যবহার এতটা আমুদে হয়নি বলেই এই পুরু দেয়ালের আবির্ভাব
*      সেতুর দৈর্ঘ্য ঢাল সহ ১৭২ ফুট (প্রায়) প্রস্থ ১৬ ফুট ইঞ্চি বিশিষ্টপানির উপরিভাগ থেকে এই সেতুর উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট যেহেতু খুব বেশি দীর্ঘ পরিমান স্ট্রেইট নিতে অক্ষম তাই সেতুর দৈর্ঘ্য খুব কম
মিরকাদিম সেতুর থ্রি-ডি ছবি


*      সেতুটি ত্রি-খিলানযুক্তপার্শ্ববর্তী খিলান থেকে কেন্দ্রীয় খিলানটি অপেক্ষাকৃত অনেক বড় আকৃতির এই খিলানের ভিতর দিয়ে এখনো জলযান চলাচল করে জলপথে এই খিলানের মধ্য দিয়ে জলযান তথা - নৌকা, ডিঙ্গি, পানশি যাতায়াত করেপার্শ্ববর্তী খিলান দুটো অন্ধকারাচ্ছন্ন সরি গলিময়  যা দিয়ে সর্বোচ্চ মাছের এপার থেকে ওপারে যেতে পারে খরার মরশুমে আবার সেতুর নীচের ভাগ শুষ্ক হয়ে মৃতপ্রায় অবস্থা হয়ে যায়
*      সেতু বা পুলের জ্যামিতিক কনফিগারেশন অনুযায়ী এতটাই বক্রভাবে লাভ করে যে অনেক ক্ষেত্রে ভারী যানবাহন উপর দিয়ে চলাটা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়  সেক্ষেত্রে পায়ে হেটে সেতু পথ পারি বা ঘোড়ার গাড়ি চলাচলের বিকল্প নেই আর এই পয়েন্ট টিতেই প্রাচীন সময় বর্তমান সময়ের যানবাহনের একটা বিস্তীর্ণ ফারাক দেখা যায়
*      সেতুর দুইপার্শ্বে যে রেলিং এর ব্যবহার,তার উচ্চতা খুব কম উচ্চতা অনুযায়ী রেলিং এর উপরিভাগে কোনাকৃতি তৈরী হয় যা দেখতে একটা ত্রিভুজের মতো
*      প্রতিটা সেতু এক-একটা ইতিহাস, সেতু সংলগ্ন খাল বা পরিখা এক-একটা ইতিহাসের সাক্ষী আবার অনেকে স্থানে সেতু সমেত স্থান জুড়ে আছে দূর্গ বা কেল্লা
মিরকাদিম সেতুর থ্রি-ডি ছবি




মিরকাদিম সেতুর বর্তমান অবস্থা
 
বর্তমানে সেতুটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অন্তর্ভুক্ত হলেও নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ছে যেমন -
*      দীর্ঘদিনের অযত্নে অবহেলায় সেতুর অনেক অংশ ভেঙ্গে গেছে
*      স্থানীয় ছেলে ছোকরাদের সেতুর উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পানিতে গোসল করা,সারা দিনের হৈ -হুল্লোড় আর হট্টগোলের কারণে সেতুর রেলিং এর একটা অংশ ভেঙে পড়েছে পানিতে
*      দেখা গেছে সেতুর নিচ দিয়ে ট্রলারসহ অন্যান্য নৌযান চলাচল করার জন্যে সময়ে সময়ে সেতুতে আঘাত লাগছে এর ফলে সেতুর দুই পাশ দারুন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে 
*      সেতু লাগোয়া স্থানে ইটের ব্যবসা চলছেসেতু সংলগ্ন জায়গা দখল করে চলছে ছোট ছোট দোকান দেয়া আর এমনি করেই জমি বেধখল হয়ে যাচ্ছে
*      সেতুর গায়ে নানা ধরণের আঁকিবুকি এই স্থাপনাকে দৃশ্য দূষণে পরিণত করেছে  

যেভাবে যেতে হয় এই ঐতিহাসিক সেতু স্থাপনায়
 
মিরকাদিম সেতু থেকে কিলোমিটার দক্ষিণে টঙ্গীবাড়ী কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মুন্সিগঞ্জ শহর অবস্থিত সুতরাং, কেউ যদি এই স্থাপনায় যেতে চায় তাকে এই সীমানা ধরেই এগুতে হবে

সেতুর সংস্কার
 
মুঘল আমলের এই দৃষ্টিনন্দন সেতুটি বহুবার সংস্কার হয়েছেএতো বেশি সংস্কারের ফলে সেতুর গাত্রালঙ্কার বেশ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বর্তমানে সেতুটি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর অন্তর্ভুক্ত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, অধিদপ্তর ২০০৬ সালে মিরকাদিম সেতুটি সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসে সেতুর বর্তমানে যে ভাঙা চূড়া নাজুক অবস্থা তা যদি খুব শীঘ্রই ঠিক না করা হয় তাহলে পরবর্তীতে সেতুটি টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আশু দৃষ্টি কামনা করছি

ডকুমেন্টেশন সহায়তায় - আফনান প্রান্ত, স্টুডেন্ট, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।


গবেষণা ও লেখাঃ শাহরিয়ার হাসান মৃধা রাতুল
স্থপতি, মৃধা’স ড্রয়িং হাউজ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা
E-mail: godhulylogonee@gmail.com
...................................................

ও এস. এম ইফতেখার আলম
 ছাত্র, স্থাপত্য বিভাগ, 
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
E-mail: efti.alam33@gmail.com

 

No comments:

Post a Comment