Friday, April 22, 2022

স্থাপত্য যাত্রা-JOURNEY TO THE CENTER OF DEPRESSION

 আফরোজ ফারিয়া:জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলো আসলে বুঝে ওঠার  আগেই শেষ হয়ে যায়। সেরকম ই একটা পর্যায় পার করছি এখন। 

স্থাপত্য স্নাতকের শেষ অধ্যায়.....যারা স্থপতি আছেন বা যারা আশেপাশে কোনো স্থপতির যাত্রাকে কাছ থেকে দেখেছেন, তারা খুব ভালোভাবেই জানেন একজন স্থপতির জন্ম হতে কতটা কাঠ খড় পোড়ানোর প্রয়োজন হয়। এক একটা প্রজেক্ট জমা মানে রাত নেই দিন নেই নেশাগ্রস্তের মতো লাল ফোলা চোখ নিয়ে বিরামহীন কর্মঘন্টা পার করা....মেরুন্ডের বেহাল দশা, প্রতিটা হাড়ের জয়েন্টের ব্যথাকে সঙ্গী করে নেয়া 😅।  রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটানোর পরে আবার আইডিয়া রিজেকশন, রিডু -এসব কোনো ব্যাপারই না। কলুর বলদের মত খেটেও সেটার এক্সেপ্টেন্সের কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। প্রথমবার পোস্টমর্টেম দেখে যেমন শারীরিক ও মানসিক ভাবে  অসুস্থ বোধ করে অনেক মেডিকেলের শিক্ষার্থী, তেমন ভাবেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থী অচেতন হয়ে গেলে বুঝে নিতে হবে সে স্থাপত্যের শিক্ষার্থী। তার স্বাভাবিক জীবনচক্রের ব্যাঘাত ঘটে রাতারাতি পাগলা খাটুনি শুরু হলো বলে কথা! 


অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা যখন নতুন নতুন ভার্সিটি ওঠার আনন্দ উপভোগ করে, তখন স্থাপত্যের শিক্ষার্থীরা কোনোদিন কাঠের দোকানে, কোনোদিন লোহার দোকানে দৌড়ে কূল পায় না। অসুস্থ হওয়া স্থাপত্যের শিক্ষার্থীর জন্য রীতিমত একটা অপরাধ😅।  এভাবেই ঝড় ঝাপটা পেরোতে পেরোতে ৫ বছর শেষ হয়। হ্যা, এম বি বি এস এর পর এটা দ্বিতীয় কোর্স যেটা ৫ বছরের গ্রেজুয়েশন জার্নি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে ৫ বছর যথেষ্ট না স্থাপত্যকে ধারণ করার জন্য। 24X7 সময় ইনভেস্ট করার পরও মনে হয় কোথায় যেন গ্যাপ থেকে গেছে। স্থাপত্যে কোনো শর্টকাট হয় না। এখানে সবচেয়ে কম নাম্বার পাওয়া ছাত্র আর সবচেয়ে বেশি নাম্বার পাওয়া ছাত্রের লাইফস্টাইলের মধ্যে প্রাপ্ত নাম্বার ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই।  সবাইকেই পাগলের মত খেটে নাস্তানাবুদ হতে হয়। তাও শেষ রক্ষা হয় না অনেকেরই একবারে। 

একে ৫ বছরের যাত্রা, তার মধ্যে কোনো ক্লাসে একবারে উত্তীর্ণ না হলে সেই যাত্রার দৈর্ঘ্য ৬-৭-৮ এমনকি ১০বছর হতেও দেখেছি। 


এত সব মানসিক, শারীরিক অত্যাচারের পরও স্থাপত্যের প্রতি ভালো লাগাটা এক ফোটাও কমে নি আলহামদুলিল্লাহ😅।  প্রতি প্রজেক্টের সময় ই নিজেকে নিজে অভিশাপ দিয়েছি কেন এত কঠিন যাত্রায় নিজেকে সম্পৃক্ত করলাম। কিন্তু সাবমিশনের পর সব কষ্ট উড়ে গিয়ে যে শান্তির ঘুম টা হয়, এই শান্তি কেনা যায় না। অনেকটা সন্তান জন্ম দেয়ার মত অবর্ণনীয় আনন্দ অনুভব হয় যখন ৬-৮ মাসের পরিশ্রম টা সাফল্যের মুখ দেখে😅। 


শুধু কষ্টের পর্বটা বলবো কেন, ভালো দিকগুলোতেও আসা যাক। স্থাপত্যের মতো সৃজনশীলতা দেখানোর সুযোগ হাতে গোণা কয়েকটা সাবজেক্ট অফার করে। প্রত্যেকটা দিনই আপনি নতুন কিছু তৈরি করবেন যার অস্তিত্ব আগে কখনো ছিল না, পুরোপুরি নতুন কোনো সৃজনে ব্যস্ত কাটবে আপনার দিন-রাত, আপনার সাথে একই ক্লাসে থাকবে চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রী, সিনেমাটোগ্রাফার, এনিমেটর, গ্রাফিক ডিজাইনার, কার্টুনিস্ট, কবি, গায়ক, অভিনেতা, পরিচালক....ইউনিক ইউনিক ট্যালেন্ট দেখা আপনার নিত্যদিনের সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হবে৷ সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে একটা স্থাপত্যের শিক্ষার্থী যখন মডেল নিয়ে হেঁটে যায়। থিসিসের ফাইনাল জুরি দেখতে অন্য ডিপার্টমেন্ট এমনকি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চলে আসে😅 এখানে শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো অদৃশ্য দূরত্ব থাকে না, পরিবারের মত হয়ে যায়। ক্লাস টাইমের কোনো লিমিট থাকে না, রাত ৯-১০টা পর্যন্ত ও স্টুডিও খোলা থাকে, কাজ চলতে থাকে, টিচার স্টুডেন্ট সবাই ব্যস্ত; রাত-দিন কোথায় কিভাবে কেটে যাচ্ছে খেয়াল করার সময় নেই কারোই😁। একই ভাবে কোনো অনুষ্ঠান, আয়োজনে শিক্ষার্থীদের সাথে সমান তালে প্রতি পদক্ষেপে ছায়ার মতো থাকেন শিক্ষকরা। ডিপার্টমেন্ট থেকে যখন তখন কোনো কারণ ছাড়া ট্যুর এরেঞ্জ করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই, পুরা ডিপার্টমেন্ট মিলে একদিন সংসদে চলে যাবেন তো অন্যদিন গ্রামের কোনো উইনিক মসজিদের স্থাপত্যশৈলী অবলোকনে নিজেকে আবিষ্কার করবেন। আপনি বুঝার আগেই আপনার স্মৃতির ঝুলিতে ধুম ধারাক্কা করে মজার সব অভিজ্ঞতা যোগ হয়ে যাবে চোখের পলকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এখানে গতানুগতিক পরীক্ষার আগে পড়ে ভালো রেজাল্ট করার কোনো সিস্টেম নেই😅 এটা একটা প্রসেস, যারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই কঠিন যাত্রাটা উপভোগ করতে পারবে নিজের সবটা দিয়ে, তারা ই সফল। তাই পড়াশুনার প্রতি যে একঘেয়েমিটা সাধারণ কোনো শিক্ষার্থীর মধ্যে কাজ করে, সেটা একেবারেই দূর হয়ে যায়, অন্তত আমার তো হয়েছে😁। পাঠ্যপুস্তকের সাথে আমাদের দেখা হয় ৬ মাসে মাত্র ১বার😂। 

নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছি আমি এই ৫ বছরে৷ আগে জানতাম না আমি যে না ঘুমিয়ে একটানা ৬-১০ দিন কাজ করতে পারি। জানা ছিল না এতটা পরিশ্রম আমাকে দিয়ে সম্ভব। নিজের কাজ করার ক্ষমতা দেখে নিজেই অবাক হয়েছি সুবহানাল্লহ। সবচেয়ে বড় যে শিক্ষাটা আমি পেয়েছি সেটা হলো একই সাথে ১০০ দিকের দুশ্চিন্তা সামলে নেয়া, সবকিছুকে একসাথে ব্যালেন্স করা, মাথা ঠান্ডা রাখা,  ধৈর্য্য ধারণ। 


ভবিষ্যতে কতটা ভালো স্থপতি হবো জানি না, কিন্তু মানুষ হিসেবে নিজেকে আরো এক ধাপ আপগ্রেড করার সুযোগ পেয়েছি। অনেক অনেক অভিজ্ঞতা যোগ হলো আমার অর্জনের ঝুলিতে। বেঁচে থাকলে চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে স্থাপত্য যাত্রার প্রতিটা মুহূর্ত। 

গত ৩৫ দিন ধরে ২-৩ঘন্টা করে ঘুমাচ্ছি....কোনো কোনো দিন ঘুম ছাড়াই কাটাতে হয়েছে, যেমন আজ....আর কতদিন এরকম চলতে থাকবে জানি না। এত এত নির্ঘুম হতাশার রাতের মাঝেও কিভাবে এই রচনা লেখার মানসিকতা এখনো আছে তাও জানি না। হয়তো একটা ঘোরের মধ্যে আছি। আবার কখনো এই ঘোরের অভিজ্ঞতা হবে কিনা জানি না, হয়তো হবে না, শুধু জানি নিজের সাথে নিজের কাটানো সবচেয়ে ভালো আর সুপার এক্টিভ সময়টা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভয়ংকর সুন্দর যেটাকে বলি আমরা.... ব্যর্থতা আর হতাশার মধ্যে যে কি অসম্ভব সৌন্দর্য্য লুকানো থাকে সেটা হয়তো কখনো জানা ই হতো না যদি স্থাপত্যে নিজেকে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে না ফেলতাম....🤍


এমন দিন না আসার প্রার্থনা কখনোই নয়, শুধু সময়টা যেন রমাদান না হয়! 😅। না করতে পারি শান্তি মনে ইবাদাহ, না করতে পারি কাজ। দোটানায় চলে যায় অর্ধেক সময়৷ 🙃


আল্লাহর কাছে আবারো শুকরিয়া এখনো পর্যন্ত সুস্থ স্বাভাবিক আছি, ক্লাস থ্রি থেকে যে সাবজেক্ট পড়ার স্বপ্ন দেখেছি সেটা পড়তে পেরেছি, যতটা ভেবেছি তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর স্থাপত্য, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।

No comments:

Post a Comment