জীবন থেকে নেয়াঃ স্থাপত্য জীবনের প্রথম চাকুরী ও DDC

১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে সমস্ত বাংলাদেশে আমরা সবাই মিলে মাত্র ১৮ জন স্থাপত্য বিদ্যায় ডিগ্রী পেয়েছিলাম। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্য্যালয় ছাড়া অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে স্থাপত্য এ ডিগ্রী দেয়া হতো না। আট কোটি মানুষের জন্য মাত্র ১৮ জন। শুনতে ও কেমন লাগতে পারে এখন । তথন চাকুরী বাজারে আমাদের দাম ছিল অনেক চড়া। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করার সময় স্থাপত্য পেশা নিয়ে যে অনিশ্চিয়তা ছিলো পাশ করার সময় তা অনেকাংশে কেটে যায়। প্রথম দিকে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ছাত্ররা আমাদের অনেকটা করুণা বা অন্য চোখে দেখত। হয়তো ভাবতো আহা বেচারারা পাঁচ বছর পড়েও বেকার থাকবে। আমাদের সিনিয়র ভাইরা আমাদের পেশার জন্যে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। আমরাও উনাদের সাথে ঢাকার রাজপথে এর জন্যে কয়েকবার মিছিল করেছি। বস্তুত উনারাই আমাদের জন্যে পথ করে দিয়েছিলেন।

পাশ করার সাথে সাথেই বন্ধুরা সবাই চাকুরী খুজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে তখন মাত্র কন্সাল্টটেন্সী ব্যবসা হাটি হাটি পা পা করছিলো। আগে পাকিস্তানী কোম্পানী গুলো এ অঞ্চলের প্রকৌশল ও স্থাপত্য ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করতো। বাংলাদেশের আভ্যুদয় এর পরে এরা সবাই এদেশ হতে চলে যায়। এ শূন্য জায়গায় বেশ কিছু বাংলাদেশী প্রকৌশলী ও স্থপতি নতুন কোম্পানী করে এ ব্যবসায়ে এগিয়ে আসে। বিশেষ করে যাদের রাজনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী ছিলো তারা বেশী সুবিধায় ছিলো। নতুন দেশে বিদেশী সাহায্য ও বেশ আসছিলো। যার ফলে নতুন কোম্পানী প্রতিষ্টা পেতেও অসুবিধা হচ্ছিল না। এ রকম বড় বড় কোম্পানীতে সবাই যোগও দিতে লাগলো। ঢাকায় আমার পরিচিত তেমন কেউ ছিলো না। মামা বা চাচার মাধ্যমে কিছু পাওয়া নেয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই চাকুরীর ব্যাপারে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। একদিন আমার আর এক প্রিয় শিক্ষক খাইরুল এনাম স্যার ডেকে বললেন বারী তোমার জন্যে আমি একটা চাকুরী ঠিক করেছি। খুব ভালো বেতন পাবে। আজই তোমাকে সে অফিসে নিয়ে যাবো। আমি অত্যন্ত আনন্দ চিত্তে তা গ্রহন করলাম।

১৯৭৬ সালে প্রথম শ্রেনী সরকারী চাকুরী জীবিদের মাসিক বেতন ছিলো ৪৭৫ টাকা। বাসা ভাড়া ও অন্যান্য সব কিছু মিলিয়ে তাতে মাসে আসতো ৮০০ টাকারও কম। সে সময় সরকারী চাকুরী নেয়ার কথা কেউ চিন্তাও করতো না। 
আমাদের বন্ধুরা সে সময় ২০০০ – ২৫০০ টাকায় বিভিন্ন কোম্পানীতে যোগ দিচ্ছিল। সবাই নতুন নতুন চাকুরী পেয়ে ভীষন খুশী।একে অপরকে বিরয়ানী খাওয়ানোর ধুম। কত আলাপ। কত কথা। কার অফিস কেমন। প্রথম দিনে কি কাজ করলো । কোন অফিসে কি প্রজেক্ট এর কাজ হচ্ছে ইত্যাদি আলাপে বন্ধু মহল মুখরিত। আসলে ছাত্র জীবন হতে বাস্তব জীবনে রুপান্তর এর অধ্যায়টুকু সবার কাছেই মনে রাখার মতো একটা স্মৃতি। 

সে যাই হোক খাইরুল এনাম স্যার আমাকে মতিঝিলের একটা অফিসে নিয়ে এলো। হক ম্যানস্যান নামক ভবনের ২য় তলায় সে অফিসটা ছিলো। নাম ডেভেলাপমেন্ট ডিজাইন কন্সালটেন্ট লিমিটেড বা সংক্ষেপে ডিডিসি লিমিটেড। অফিস দেখে ত আমার মাথায় হাত। এতদিন যা কল্পনা করে আসছিলাম বাস্তবে তার কোন মিলই খুজে পেলাম না। ছোট একটা অগোছালো অফিস।খুব বেশী হলে ১৬ফুট চওড়া ও লম্বায় ২৫ফুট হবে। দুটো মাত্র রুম আর সাথে একটা প্যাসেজ। এক রুমে কোম্পানীর এমডি বসে। আরেক রুম আমার ও অন্য এক ইঞ্জিনিয়ার এর জন্যে রাখা। প্যাসেজে আবদুল হক নামে একজন বাকপ্রতিবন্দি ভদ্রলোক ড্রাফটস ম্যান হিসেবে কাজ করছিলো। বাবুল নামে আর একজন পিয়ন কে দেখলাম। ফজর আলী নামে আরেক জন কে পেলাম যিনি নিজেকে ম্যানাজার হিসেবে পরিচয় দিলো। হক সাহেব আকারে ইংগিতে জানালো যে সে আমার জন্যেই অপেক্ষা করছে। এ হলো অফিসের কাহিনী।

আমার চেহারা দেখে স্যার বুঝতে পারলো যে অফিসের পরিবেশ আমার পছন্দ হয়নি। উনি বললেন একটু দাঁড়াও রফিক ভাই আসুক। আলাপ করেই আমরা চলে যাব। কিছুক্ষন পরেই একজন ঢুকলেন। ভদ্রলোককে খুব সহজ ও সরল মনে হলো। খাইরুল এনাম স্যারই উনার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন রফিক ভাই হিসেবে। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। চাকুরী করি বা না করি কিছুটা ভয় অবশ্যই ছিলো। কিন্তু হবাক হলাম ভদ্রলোকের কথা শুনে। প্রথম কথাই বললো তুমি কবে জয়েন করতে পারবে। ঠিক আছে কাল হতেই কাজ শুরু করো। তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো কাজ করবে। আমাকে ভাইয়া হিসেবে ডাকবে। আর বেতনের ব্যাপারে কোন চিন্তা কোর না। তোমাকে তোমার ক্লাসের সমস্ত বন্ধুদের চেয়ে বেশী বেতন দেব। তারপর জিজ্ঞেস করলেন তোমার বন্ধুরা বেতন কত পাছে। আমি মাসিক ৩০০০ টাকা বলার সাথে সাথেই উনি আমাকে তার সাথে ৫০০ টাকা যোগ করে বললেন তোমার প্রাথমিক বেতন হবে মাসে ৩৫০০ টাকা। কি রাজি আছ। আজব ব্যাপার। কোন প্রশ্ন ছাড়াই ইন্টারভিউ এবং চাকুরী। তার উপর সর্বোচ্চ বেতন। সে মূহুর্তে আমার কাছে বেতন বা অফিসের পরিবেশের কথা মনে হচ্ছিল না আমি অনেকটা অবাক হয়ে রফিক ভাই এর কথা অবাক হয়ে শুনছিলাম । সত্যি বলতে কি উনাকে আমার ভীষন ভালো লেগে গেলো। আমার পেশাগত জীবনকে উনার সাথে জড়াতে মন বাধা দিলো না। এবং আমি সাথে সাথে হা বলে দিলাম।

তারপরের দিন হতেই আমার চাকুরী জীবন শুরু হোল। 
বেশ মজার ছিলো সে দিন গুলো।তখন আমরা Ishwardi আখ গবেষনা কেন্দ্র পরিকল্পনা করছিলাম।সে সময় ডঃ মতলুবুর রহমান সে কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছিলেন। যিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ও ভালো মনের অধিকারী।আমার সাথে উনার একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। উনি কাজের অবসর পেলেই আমার কাছে চলে আসতেন। উনার কাছ হতে আখ ও এর উপর অনেক তথ্য আমি জেনেছিলাম। যাই হোক অফিসে রফিক ভাই আমার সাথে ডিজাইনে অংশ গ্রহন করতো। উনার সাথে আমার সে সময় একটা দারুন পেশাগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। খাইরুল এনাম স্যার আমাকে কন্সেপ্ট বলে দিতো আর আমি সেটা একে ফেলতাম। 

ভীরু ভীরু মন নিয়ে আমার পেশাগত জীবন শুরু হলো। রফিক ভাইয়া আমাকে অসম্ভব সহযোগিতা ও সহায়তা করতো। আমি অফিসের প্রজেক্টসমুহের স্থাপত্য দিকগুলো দেখতাম আর উনি নিজ হাতে প্রকৌশল ডিজাইন ও তার সমাধান করতেন। আমি ইতিমধ্যেই ফরিদপুর সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ, খুলনা ডাক বিভাগের ডরমেটরী, এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথারেটির পানির ট্যাঙ্ক, কুমিল্লা জিলা বোর্ডের শপিংসেন্টার ও আরো কিছু কাজ করে হাত পাকিয়ে ফেললাম। আমরা দুজনে ডিজাইন ছাড়াও সাইট সুপারভিশনে যেতাম। ইশ্বরদীতে উনার সাথে অনেকবার গিয়েছিলাম।খুলনার মংলাতেও বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম।

একবার বিমানে ইশ্বরদী যাবার সময় সে সময়কার মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ফরাক্কা মিছিল দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সেদিনের কথা এখনো আমার মনে আছে। সারা দেশ তোলপাড়। ভারতের পদ্মা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নিমানের প্রতিবাদে সবাই মুখর। সেদিন ১৬ই মে ১৯৭৬ সাল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বিশাল মিছিল রাজশাহী অভিমুখে রওনা হয়েছিলো।আমি আর রফিক ভাই সেদিনই বিমানে করে ঈশ্বরদী যাচ্ছিলাম। সে বিমানের কেপ্টেইন ছিলো রফিক ভাইয়ার বন্ধু। উনি বিমানের যাত্রা পথ কিছুটা পালটিয়ে আমাদেরকে উপর হতে সে মিছিল দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।সে বিমানে ঢাকা হতে আমরা মাত্র চার জন যাএী ছিলাম। চট্টগ্রাম ছাড়া অন্যান্য রুটে বিমানে সে সময় যাত্রী পাওয়া কঠিন ছিলো। খুবই মজা লাগতো এভাবে সাইট ভিজিট করতে। 

রফিক ভাইয়ার আরেকটা অদ্ভুদ খেয়াল ছিলো তা হলো কারনে অকারনে বই কেনা। অনেক দিন উনার সাথে আমি বায়তুল মোকাররম ও স্টেডিয়ামের ফুটপাথ ঘুরে ঘুরে পুরানো বই কিনেছি। টগবগ তারুণ্যে আমি সারাদিন এবং অফিস সময়ের পরও কাজ করতাম। টার্গেট নিয়ে কাজ করে তা শেষ করে ফেলতাম। স্থাপত্যের অনেক ডিটেইলস বই ও অন্যান্য ড্রইং হতে শেখার চেষ্টা করতাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ফাকি বা অবহেলায় সুযোগ হারালে আমার মত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরই বিপদ হবে। 

আমার যোগদানের কিছু দিন আশরাফ নামের একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ডিডিসি তে যোগ দেয়।তখন ডিডিসি পরিবার এক স্থপতি, এক ইঞ্জিনিয়ার ও এম ডি নিয়ে তিন জন হয়েছিলো। আমিও সব সময় আলাপের জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার পেয়ে গেলাম। তাতে আমারও সুবিধা হয়েছিলো। 

রফিক ভাইয়া প্রায় প্রতিমাসে আমার বেতন বাড়িয়ে দিতেন। তখন মনে মনে আনন্দ পেতাম এই ভেবে যে আমার বেতন সহপাটি সবার চেয়ে সব সময় অনেক বেশী ছিলো।

আজ ৩০ বছর পর মনে হচ্ছে ডিডিসিতে যোগদানের সিদ্ধান্তটা নিতে আমার ভুল হয়নি। এ অফিস হতে পেশাগত যে ভিত্তি আমি পেয়েছিলাম তা আমার পরবর্তী জীবনে অনেক কাজে দিয়েছে।এখানে কাজ করে আমার বিশ্বাস জন্মে ছিলো আমি নিজে একক ভাবে যে কোন প্রকল্প ডিজাইন করতে পারি। নিজে তা একে প্রকাশ করতে পারি,সাইট ভিজিটে কঠিন প্রকৌশল সমস্যাগুলো সামলাতে পারি।একজন নতুন পাশ করা স্থপতির পক্ষে এ আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা একটা বিরাট ব্যাপার। আর এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কাজ করার সাহস আমি পেয়েছিলাম। 

আর সেদিনের ডিডিসি লিমিটেড ছোট্ট চারা হতে বটগাহ হয়ে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কোম্পানীতে রুপান্তরিত হয়েছে।
আর প্রকৌশলী এ কে এম রফিকউদ্দিন বাংলাদেশের প্রকৌশল জগতে এক জন সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। আমার সাথে রফিক ভাই এর সম্পক’ সব সময় অটুট আছে।

মাত্র ১২ মাস চাকুরী করেই সে বার আমাকে ডিডিসি ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে হয়েছিলো। এরপর বিভিন্ন দেশে কাজ করে বেড়ালেও ডিডিসির দরজা আমি সবসময় খোলা পেয়েছি। পেশাগত জীবনে যে কোন প্রয়োজনে বড় ভাই হিসেবে উনি সব সময় আমার পাশে ছিলেন। ভীরু পায়ে ঢুকা জীবনের প্রথম চাকুরীর সে ডিডিসি লিমিটেড আমাকে কোম্পানির অন্যতম পরিচালক হিসেবে সন্মানিত করেছে আর অন্যদিকে আমার বন্ধুদের যোগ দেয়া আনেক বড় বড় কোম্পানী সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে। 
সব কিছুর জন্য মহান আল্লাহর কাছে হাজারো শোকর। আল্লাহ সবাইকে সুন্দর, সুস্থ ও সুখী রাখুক। আমিন।

লিখেছেনঃ Architect.Chowdhury Fazle Bari Sir

No comments

Powered by Blogger.