বঙ্গবন্ধু, স্থাপত্যাচার্য এবং দ্বিধান্বিত সাধারণ স্থপতি --মোহাম্মদ মাসুম

 
N.B. 'সাধারণদের ভুল হয় বেশি, তাই বোদ্ধ্যারা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে সাধারণ হিসেবে হয়তো প্রাণে বেঁচে যাওয়া যায়, আর সাহায্য করলে অনেক কিছু শিখেও নেওয়া যায়
রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষ হিসেবে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু নিয়ে বলতে গেলে যেই রকম সাবধানে কথা বলতে হয় (পক্ষে বিপক্ষে উভয়ক্ষেত্রে); স্থপতি হিসেবে স্থাপত্যে যিনি আচার্য- মাজহারুল ইসলামকে নিয়ে কথা বলতেও একই বিপত্তি, আর তাই ভয়ে ভয়েই লিখতে হয়, কারণ সুবিধাবাদী আওয়ামী লীগাররা যেমন বঙ্গবন্ধুকে তাদের সম্পত্তি মনে করেন, স্থাপত্যাচার্যও বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় স্থপতি আর স্থাপত্য বোদ্ধাদের সম্পত্তির মতোই মনে হয়- বঙ্গবন্ধু যেমন সাধারণ মানুষের ধরাছোয়ার বাইরে, স্থাপত্যাচার্যও সাধারণ স্থপতিদের অনুভূতির ঊর্ধ্বে- কারণ উনারা অসাধারণ ছিলেন, আর অসাধারণ স্বপ্নই দেখতেন, আর উনাদের ৭১ এর অসাধারণ স্বপ্নিক সাফল্য যখন অচিরেই ৭৫ এর বিফলতায় নিমগ্ন হয়, তখন জাতি হিসেবেও কালক্রমে স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপদানের আমাদের স্পৃহা বিনষ্ট হয়, স্বকীয়তা ভুলে গিয়ে চাটুকারিতায় নিমগ্ন হই, স্থাপত্যেও ব্যাতিক্রম হয়নি- স্বকীয়তা ভুলে গিয়ে অনুকরণ সর্বস্ব হয়ে গিয়েছি, প্রকৃত আদর্শের রাজনীতির যেমন মূল্যায়ন হয়নি, স্বকীয়তা নিয়ে স্থাপত্য চর্চাও কি মূল্যায়ন হয়েছে? প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ (কখনো প্রতিষ্ঠিত পদে থাকলে তবেই প্রথিতযশা) ছাড়া যেমন রাজনীতি নিয়ে মতবাদ দিয়ে বিপদে পড়তে হয়, তেমনি প্রথিতযশা স্থপতি না হয়ে স্থাপত্য নিয়ে মন্তব্য করে কি বিপাকে পড়বো জানিনা, কিন্তু স্থপতি হিসাবে দায়বদ্ধতা থেকেই বলার অনুপ্রেরণা বোধ করছি--
মাজহারুল ইসলামকে নিয়ে তারাই বলবেন যারা প্রথিতযশা স্থপতি, কারণ উনি সাধারণ স্থপতিদের বোধগম্যতার উর্দ্ধে, আর বোদ্ধারা তো উনার কাজের বিন্যাস করে জাতিকে 'স্থাপত্যাচার্য' উপাধি উপহার দিবেন, যেমন 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি বুকে ধারণ করে 'জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগান দিয়ে জাতি বিমোহিত, কিন্তু তার আদর্শের কিছুই জানা নেই, তেমনি 'স্থাপত্যাচার্য'র স্থাপত্যিক আদর্শ নিয়ে আমরা কতটুকু দিকনির্দেশনা পাই? বোদ্ধাদের দেখানো 'স্থাপত্যাচার্য' উপাধি নিয়েই আমরা বিমোহিত হই- কিন্তু অনুকরণ আর নকলে ছেয়ে গেছে আমাদের স্থাপত্যের চর্চা, দেশীয় স্থাপত্যের স্বকীয়তার নিদর্শন 'স্থাপত্যাচার্য'র কাজের মূল্যায়ন অথবা পর্যালোচনা করার অধিকার আমাদের এই স্থপতি সমাজের নেতৃস্থানীয় স্থপতিরা রাখেন কিনা এই নিয়ে আমি দ্বিধান্বিত, এ যেন স্বৈরাচারী এরশাদের মুখে বঙ্গবন্ধুর স্তূতি, স্বৈরতন্ত্রের মুখে গণতন্ত্রের আস্ফালন- এই প্রজন্ম আমরা দ্বিধানিত না হয়ে উপায় কোথায়- বিশিষ্ট স্বনামধন্য স্থপতিরা যখন বিভিন্ন দেশের স্থপতিদের কাজের নকল করেন আর নেতৃস্থানীয় স্থপতি হয়ে নতুন প্রজন্মকে পথ দেখানোর ঔদ্ধত্য দেখান, তখন মাজহারুল ইসলামকে 'স্থাপত্যাচার্য' হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হয়- কারণ উনিতো লুই আইকানকে নকল করেননি, তদুপরি এই ইনারাও স্থাপত্যাচার্যের গুনাগ্রহীই শুধু নন, নিজেদেরকে উনার আদর্শের প্রতিনিধিত্বকারীও মনে করেন, আমরা দ্বিধান্বিত না হয়ে উপায় কি?
সাধারণ হিসেবে সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য হন্নে হয়েই ছুটে বেড়াচ্ছি আমরা, শুধু এতটুকুই অনুভব হয়- কাজ লাগবে۔ কাজ করে দেখাতে হবে- তাহলে উনি কাজ পেতেন কিভাবে? সরকারী দপ্তরেরই সব কাজ করতেন তো- তখনতো আর প্রাইভেট মক্কেল ছিল না- তাহলে সরকারী কাজ গুলো গেলো কোথায়? স্বনামধন্য সকল স্থপতি তো দেখছি এপার্টমেন্ট, রেসিডেন্স আর কর্পোরেটদের কমার্শিয়াল ভবন নিয়েই ব্যস্ত, যদিও কিছু NGO র কাজও চোখে পরে, ইদানিং ফ্যাক্টরি ভবনও হচ্ছে প্রচুর- আর দেশে বিদেশে এই প্রকল্পগুলোই আবার স্থাপত্য পুরস্কারও নিয়ে আসছে, তাহলে হচ্ছেটা কি আসলে? সরকারী কাজগুলো কি তাহলে বেসরকারি কাজগুলোর মানের হচ্ছেনা? কিন্তু সরকারি কাজের পরিমানই তো অনেক বেশী- মোটামুটি ৫-৬ গুনতো হবেই, 'সরকারি দপ্তরে বসে ভালো স্থাপত্য সম্ভব নয়'- এই রকম কোন কারণ থেকেই কি তাহলে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস থেকে সরকারি কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্থাপত্যাচার্য? তাহলে আমরা সরকারি প্রকল্পের স্থাপত্যকে পুনরায় সরকারি দপ্তর কেন্দ্রীক করে আসলে কি অর্জন করতে চেয়েছি? 'স্থাপত্যাচার্য' কি শুধুই স্থাপনার চিন্তার ধারা নিয়ে কাজ করেছেন, নাকি Procurement এর প্রক্রিয়া নিয়েও আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন- যদি কাজই না থাকে তাহলে দেশীয় স্বকীয়তা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করেই বা কি লাভ? যত সামান্য সরকারি প্রকল্প অবশ্য competition এর আয়োজন করে হচ্ছে বটে, তবুও Star স্থপতি আর বোদ্ধা তারাই যারা ব্যবসায়িক ভাবে সফল, হাজার হউক তাদের স্থাপত্যই তো দেখা যাচ্ছে এইখানে ওইখানে, সত্যজিৎ রায়ের Art Film দিয়ে তো আর পেট ভরেনা, ধামাকা ও হয়না, তাই কিছু Pretigious Award দিয়েই কারো কারো মূল্যায়ন হয়, তবুও অন্নান্য স্বনামধন্যরা আবার বলে বেড়ান- অনেক ভাবেই তো পুরস্কার পাওয়া যায়- কিন্তু কাজতো আমাকে দিয়েই করাচ্ছে- সিনিয়রদের সম্মান করার কারণেই মনের কথা আর মুখে উঠে আসেনা- 'তাহলে আপনার পুরস্কার গুলোও কি ওভাবেই পাওয়া?' তখন মনে হয়- পুরস্কার দিয়ে বিচার করলেও তো 'স্থাপত্যাচার্য' উপাধি কি তাহলে ভুল মূল্যায়ন নয় তো? আবারো দ্বিধান্বিত হই--
বাবার মত ছিলোনা বিধায় উচ্চমাধ্যমিকের পর যুক্তরাষ্ট্রে Astro-physics পড়ার বৃত্তি বিসর্জন দিয়ে সর্বশেষে অবশিষ্ট খুলনা বিশ্ববিদ্দ্যালয়ে স্থাপত্যে স্নাতক করে যখন জ্ঞানের অন্নেষনে বিলাতে আসি- আর জগৎ বিখ্যাত Bartlett থেকে Research Associate হয়ে Post Graduate করার পাশা পাশি Urban Regeneration সহ Olympic Project এর মতো মেগা প্রজেক্ট গুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করি, তখন ভেবেছিলাম দেশে গিয়ে কিছু অবদান রাখা নৈতিক দায়িত্ব- কিন্তু হায়রে কপাল- এই দেশে টাকা থাকলে গার্মেন্টসের ব্যবসায়ী রাতারাতি রাজনীতিবিদ-নেতা-মন্ত্রী বনে যায় আর বোদ্ধারাও তার চাটুকার হয়ে যান, সম্পর্ক থাকলে এপার্টমেন্ট এর ছাদ বাগান থেকে Urban Designer হয়ে যাওয়া যায়, আর পুরস্কৃত হলে তো কথাই নাই, এপার্টমেন্টের স্থপতিও Ocean Hydrology নিয়ে মতামত দিয়ে বসে, আর আমরাও লাফাই, এই বনে বানর রাজা, বানরের গলায় মুক্তার মালা পরিয়ে কি লাভ? আসলে এতদিন কি তাহলে ভুল শিখেছি? এতদিন শিখেছি একটি প্রক্রিয়া (Thinking Process), আর এখন দেখছি পণ্যই জরুরী- খ্যাতি আর খ্যাতিমানদেরই দৌরাত্ম- আবারো দ্বিধান্বিত হই- কিন্তু এখনো বিশ্বাস করেই এগুতে চাই- 'বঙ্গবন্ধু' বা 'স্থাপত্যাচার্য' এইগুলো শুধুই উপাধী নয়, এইগুলো হলো এক একটি প্রক্রিয়া, পণ্য নয়- যদি এই বিশ্বাসটি ভুল হয়ে থাকে তাহলে এই দ্বিধান্বিত সাধারণ স্থপতিকে নিজ গুনে ক্ষমা করে দিয়ে পথ প্রদর্শনের অনুরোধ রইলো-

No comments

Powered by Blogger.