দুইদেশের সম্পর্কোন্নয়ন, নিজের দেশের প্রবাসী নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করা, কূটনৈতিক সমস্যা সমাধানে কাজ করা দূতাবাস সর্বোপরি নিজের দেশকে তুলে ধরে অন্য দেশের বুকে। দূতাবাস নকশায় তিনভাবে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।
১। দুই দেশের সম্পর্ককে তুলে ধরতে সাংস্কৃতিক এবং স্থাপত্যিক সমন্বয়
২। নিমন্ত্রাতা দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নকশা প্রণয়ন
৩। নিজ দেশের সাংস্কৃতিক এবং স্থাপত্যিক ধারা প্রকাশ।
স্থাপত্যভাবনাঃ
তুরস্কে বাংলাদেশ দূতাবাস নকশার এই থিসিস প্রজেক্টটিতে অগ্রসর হওয়া হয়েছে এমনভাবে যা তুরস্কের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশের ছবি আঁকে। এখানে এমন একটি স্থাপত্য নকশার চিন্তা করা হয়েছে যা বাংলাদেশের আদি স্থাপত্যিক রূপ থেকে উৎসারিত। তবে এক দেশের স্থাপত্যিক রূপকে আরেক দেশে নিয়ে আসা সহজ কাজ নয়। কারণ স্থাপত্য মাত্রই জলবায়ু, জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে জড়িত। এই কঠিন এবং সংবেদনশীল কাজটা সঠিকভাবে করতে গিয়ে অর্থাৎ মৌসুমি জলবায়ুর দেশের আদি স্থাপত্যকে গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুর দেশ তুরস্কে স্থাপন করতে গিয়ে সমন্বয় করতে হয়েছে নানা কিছু।
আঙ্কারা, তুরস্কঃ
তুরস্ক একটি আন্তর্মহাদেশীয় দেশ যার প্রায় পুরো অংশই পশ্চিম এশিয়া এবং ছোট একটি অংশ পূর্ব ইউরোপের অন্তর্গত। রাজধানী আঙ্কারা তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং অন্যতম পুরোনো শহর। গরম-গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুর শহর আঙ্কারা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, যেখানে ঢাকার উচ্চতা প্রায় ৪ মিটার। এই উচ্চতা এবং অবস্থানের কারণে আঙ্কারার আবহাওয়া অনেকটাই চরমভাবাপন্ন। তুরস্কের প্রধান চারটি জলবায়ু অঞ্চল এর মধ্যে এই সাইটটি Terrestrial Climate এর অন্তর্গত। এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে আগস্ট মাসে (৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং সর্বনিম্ন জানুয়ারি মাসে (৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। জলীয় বাষ্পের পরিমাণ খুবই কম হওয়ার কারণে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা অনেক বেশি অনুভূত হয়, অপরদিকে শীতকালে তুষারপাত হয়ে থাকে।
সূর্য এখানে দক্ষিণে হেলে থাকে। উত্তর দিক থেকে বছরজুড়ে বাতাস আসলেও তা ব্যবহার উপযোগী নয়। এখানে দক্ষিণ দিক ব্যবহার করেই বাড়িগুলোর নকশা করা হয়। এই জলবায়ুর অন্তর্গত অঞ্চলে Semi outdoor space বা বারান্দার ব্যবহার নেই বললেই চলে।
১৯২৩ সালে আঙ্কারাকে একটি পরিকল্পিত রাজধানী শহর হিসেবে মনোনীত করার পর ৫০ এর দশকের পর থেকে বেকারত্ব, দারিদ্র এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি এ শহরে প্রচুর বসতি গড়ে তোলে। সাড়ে পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি আঙ্কারায় ১২৬ টি দূতাবাস রয়েছে।
সাইটঃ
আঙ্কারা প্রদেশের ২৫টি জেলার অন্যতম কানকায়ার কূটনৈতিক এলাকা ওরানে ১.১৩ একর জুড়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। তুরস্কের জলবায়ুর কারণে স্বাভাবিকভাবেই এটি একটি রুক্ষ এবং ঢালু জমি।
স্থাপত্যিক উপাদানঃ
১। বাংলাদেশকে স্থাপত্যের মাধ্যমে তুলে ধরতে গিয়ে চলে যেতে হয়েছে বাংলাদেশের স্থাপত্যের শিকড় অর্থাৎ আদি রূপের কাছে।
২। স্থাপত্যে আধুনিক নির্মাণ উপকরণের চাকচিক্য বা স্টিল কাঠামো মিলে যায় অন্য অনেক দেশের সাথেই। শুধুমাত্র হেলানো দোচালা ছাদ যা আমরা আমাদের ছোটবেলার ছবি আঁকায় খাতায় এঁকেছি, তা একবারেই আমাদের নিজস্ব। এমনকি বিশ্ব স্থাপত্য দরবারে তা Bangla Roof নামে পরিচিত। এই প্রজেক্টের অন্যতম উপাদান তাই এই Bangla Roof.
৩। উঠান আমাদের আদি স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় উপকরণগুলোর একটা। উঠানকে ঘিরেই আমাদের বারান্দা এবং ঘরগুলো। তাই উঠানের (Courtyard) চারপাশে বৈঠকখানার মতো করে এখানে সাজানো হয়েছে কার্যক্রম গুলো।
রূপান্তরঃ
১। স্থাপত্যভাবনার রূপান্তরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ভীনদেশের ভিন্ন রকমের ১.১৩ একরের সাইটটি। তুরস্কের মরুর মতো রুক্ষ এবং ঢালু এই জমিতে বাংলাদেশের স্থাপত্যিক ছবি আঁকার কাজটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং।
২। পানি আর সবুজ ছাড়া বাংলাদেশ চিন্তা করা সম্ভব নয়। এই রুক্ষতার মাঝে পানি ও সবুজকে এমনভাবে আনতে হয়েছে যাতে যাতে সকল স্থানে উপযুক্ত তাপমাত্রা থাকে।
৩। গাছের প্রজাতি বাছাই করার ক্ষেত্রে ওই অঞ্চলের যেসমস্ত গাছের বিস্তার (canopy) এবং উচ্চতা আমাদের দেশের গাছের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।
৩। মূল ভবনের চারিদিকে আয়তাকার জলাধার এশিয়ায় বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশকে প্রকাশ করার পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করছে। নিরাপত্তা যেকোন দূতাবাস কাঠামোর প্রধান বিষয়। এই প্রজেক্টটিতে চলমান সাধারণ নিরাপত্তার পাশাপাশি কনস্যুলার উইং এর প্রবেশ আলাদা করা হয়েছে। আবার লোকালয়মুখী অবস্থানের কারণে প্রজেক্টটি কোনপ্রকার বৈরী প্রভাব ছাড়াই নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
৪। তুরস্কের এই অঞ্চলের স্থাপত্য ধারায় ব্যবহৃত বায়ু চলাচলের প্রাকৃতিক পন্থাকে মাথায় রেখে জলাধার এবং গাছের ব্যবহার করা হয়েছে যেন প্রজেক্টটি বাংলাদেশের স্থাপত্যরূপ পাওয়ার পাশাপাশি তুরস্কের পরিবেশের উপযোগী হতে পারে।
৫। Semi outdoor space অর্থাৎ বারান্দা আমাদের সংস্কৃতির অংশ, আমাদের স্থাপত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই বারান্দা গুলো আমাদের উঠানকে এবং আমাদের অন্দরমহলকে জোড়া লাগায়। আঙ্কারার বৈরী আবহাওয়াকে মাথায় রেখে প্রজেক্টটির নকশায় জানালাগুলো দেয়া হয়েছে পুরো দেয়ালজুড়ে, যা আমাদের বারান্দা-ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আঙ্কারার আবহাওয়া-উপযোগী। সর্বোপরি একাধিক ফর্মে থাকা কমপ্লেক্সটি আমাদের গ্রামের বাড়ির একাধিক ঘর থেকেই অনুপ্রাণিত।
আমাদের আদি স্থাপত্যচর্চা আমাদের আদি পরিবার কাঠামো, সংস্কৃতি, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট ও জলবায়ু থেকে উৎসারিত। তাই এই চর্চা থেকে তুলে আনা উপাদানসমূহের সঠিক সমন্বয়ের নকশা একটি স্থাপত্যকে বাংলাদেশি স্থাপত্য হিসেবে অনন্য করে তুলতে পারে।
অর্থাৎ,
১। ছাদের কাঠামো/আকৃতি
২। উঠান
৩। পানি এবং সবুজের উপস্থিতি
৪। খোলা জায়গার সাথে সম্পর্ক
৫। গুচ্ছ কাঠামো
এই স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী দূতাবাস নকশা প্রণোয়নে প্রয়োগ করা সম্ভব, যার মাধ্যমে যেকোন দেশে তৈরি হতে পারে এক টুকরো বাংলাদেশ।
No comments:
Post a Comment