‘সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ আলাদা, কারণ প্রতিটি ধাপ থেকে দেখার ভঙ্গিটাই পাল্টে যায়’
‘প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কত সুন্দর করে বয়ান করতে পারছ সেটা জরুরী নয়, যদি পারো তো তাকে তোমার শ্বাস দিয়ে গিলে নাও’
সুপ্রভা জুঁই|| দোশি’র উপরে তাঁর নাতির বানানো এই শর্ট ডকুমেন্টরিতে তাঁর প্রতিটা কথা একজন এক্টিভিস্ট স্থপতি’র জন্য কুরআন এর বানী’র মতন। স্থাপত্যবিদ্যাকে ভালোবাসার আগে তাঁকে আমি ভালোবেসেছি তাঁর প্রজেক্টের একজন user হিশাবে। আহমেদাবাদের CEPT বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার সময় একজন outsider হয়েও মনে হয়েছিলো এ আমার কত আপনা!
এই দোশি যখন আমার দেশে আসছেন আমাদের জন্যই কথা বলতে তখন সেখানে উপস্থিত থাকার সুযোগটা মিস করার কথা জাস্ট ভাবাই যাই না। এমনভাবে তৈরি হলাম যেন প্রেমিকের সাথে ডেটিং যে যাচ্ছি! ঠিক সময়ে হাজির হয়ে আগেভাগে জায়গা দখল করে একেবারে গেঁড়ে বসলাম। যথা সময়ে তাঁর আগমন। তাঁর কণ্ঠ এবং তাঁর শারীরিক উপস্থাপনা তাঁর প্রজেক্টের মতই কাছে টেনে নেয়। এত আপনা! মনে হয় উনি আমার ভালোবাসা জেনেছেন। তাই আমার দিকে তাকিয়েই কথা বলছেন!
এই যে আমার গভীর প্রেম তাঁর প্রতি সেটা কেন হলো সেই কথাটায় বলবো এবারে। আপনারাও প্রেমে না পড়ে থাকতে পারবেন বলে খুব একটা মনে হয় না। আলোচনায় দোশি তাঁর নিজের কাজের ধরণ এবং চিন্তা’র কথায় বলেছেন। লুই কান একবার প্রেমিকা এন টিং -কে চিঠিতে লিখেছিলেন যে, তিনি চিঠিতে সারাটাক্ষণ কেবল কাজের কথায় বলেন, নিজের কথা আর বলা হয়ে ওঠে না। কারণ কাজের মাঝেই তো তিনি সব থেকে বেশি ছড়িয়ে আছেন! সেখানেই তাঁর একমাত্র বিচরণ এবং সেটি-ই তাঁর একমাত্র পরিচিতি।
দোশি’র ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। আসলে সোশ্যাল এক্টিভিস্ট যারা তাঁদের সকলের ক্ষেত্রেই বোধ হয় এই দর্শন খাটে। দোশি তাঁর আলোচনায় একটা কথা প্রায়ই ব্যবহার করেছেন, ‘so called architect’ এই সো কল্ড আর্কিটেক্ট হলো আমার মতে প্রফেশনাল স্থপতি। এজন্য Architecture শব্দটি খুব confusion তৈরি করেছে বলে তাঁর ধারণা। এক্টিভিস্ট স্থপতিকে কোন ফ্রেমে আবদ্ধ করা খুব্বি কঠিন। এই জন্য শব্দটির ভাবের মাঝে যে সীমাবদ্ধতা আছে তিনি সেটা অপছন্দ করছেন। স্থাপত্যবিদ্যা-কে কোন কিছু থেকে পৃথক করার সুযোগ নেই, এটা one entity। সে কথায় বললেন তিনি।
দোশি জানালেন, সৃষ্টিশীলতা নদীর মতন। বইতেই থাকে। কিন্তু বাঁক আসে তখনই যখন উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় অর্থাৎ direction। উত্তরের প্রশ্নটা সেক্ষেত্রে হয়- আমার চরিত্র কেমন বা, আমি যাচ্ছিটা কোথায়?
একটা স্বাধীন নদী’র সেই পরিচিতি আছে।
উফফ এই পরিচিতি!!! এই পরিচিতি-ই তো গিলে খাচ্ছে সেই কবে থেকে!
গতকালও এই লেকচার দেখতে যাওয়ার সময় বিষণ্ণ আমি বাসের মাঝে এভারনোটে এরকমই বিভ্রান্তি’র কথা লিখেছিলাম। ভাবিনি যে আর একটু পর দোশি-ই দিশা দিবেন! একেবারে নিজের জন্য লিখাটা তাও তুলে দিচ্ছি কারণ এই লিখাটাও একেবারেই নিজের জন্যে-
আমরা বলি যে আমরা সৃষ্টি করছি। কাজ কে নিজের সন্তানের মতন ভাবি। আমি আমার কাজকে সন্তানের মত ভাবার অবকাশ পাই না কারণ এর আগে আমার নিজের একটা সন্তান থাকা চাই। কিন্তু এটা জানি কি রকমের আচরণ বাবা মায়ের থেকে প্রত্যাশা করি না। আমি পারফেকশনিস্ট না। কিন্তু বাতিকগ্রস্ত। “একটা সময় পর ছেড়ে দিতে হয়”- এরকম করে ভাবতে পারি না এখনো। আমার লক্ষ্য এত দূরে থাকে যে তাতে পৌঁছানোর জন্য যে সময় এবং নিয়োজিত থাকার জন্য যা যা মৌলিক বিষয় দরকার তার যোগান করা সম্ভব না বা সহজ না। ফলে একটা সময় পর আমি টোটালি ছেড়ে দেই। সেটার কোন গঠন নেই। এসমস্ত অপুষ্ট সন্তান আমারই সৃষ্টি কিন্তু তাদের স্বীকার করি না। চাই না লোকে তাদের দেখুক। অপমানিত বোধ করি। ধ্বংস হয়ে গেলেই খুশি হই। কিচ্ছু বড় মন নয় আমার। কচু! সমাজে যত মানুষ তাদের অনেকের হৃদয়ের বিশালতা নিয়ে প্রশ্ন তুলি অথচ আমার সৃষ্টির মাঝে আমি নির্বাচন করছি, সেরা বলছি, কিছু ট্রাশ ক্যানে যাচ্ছে, কিছু আগুনের শিখায়। এই নোংরা আকাংখা নিয়ে বাস করি আমি।
নিজেকে ভালোবাসা আসলে কি? এত এত সব মনোহরা সুফি বা পজিটিভিটির বাক্য দেখি রোজ। দেখি আর উল্টো আরো কনফিউজ হই। লাইফের কন্ট্রোল না নিয়ে জাস্ট লেট ইট গো/ বায়োজিদ বুস্তামি পৃথিবী পরিবর্তনে গেলেন হলো না, পরিবারের লোকজনাকে পরিবর্তনে গেলেন হলো না, এরপরে নিজের কাছে চলে এলেন কারণ এই একটা জায়গায় আছে তার চর্চার যেটা আসলেই পরিবর্তিত হবে।
একজন মুমিন ব্যক্তিই পারেন সমাজ, মানুষ নিয়ে ভাবতে আর নকশা করতে। আমি না।
ভবিষ্যৎ এর ভাবনা ভাবায় হলো জ্ঞানীর কাজ/ অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে পথ চলতে হবে/ অতীতে যাওয়ায় হলো অগ্রগতি।
মাঝে মাঝে শুনতে হয় বেশি পইড়া ফেলছি বলেই এসব ভাবতেছি। ভয়াবহ ভুল কথা। কত কম পড়া আমার আমি জানি। অলসের জায়গা থেকে নয় কিন্তু কোন ফোকাস নাই আমার। আমি’র খোঁজের জন্য বেসালাম আমি। ও আমার গুরু, কই আপনি?!
শহরের ব্যস্ত রাস্তায় বাসের মাঝে ঝুলতে ঝুলতে ঐসব আমিদের দেখতে পাই যাদের আমার পরিচয় থেকে সরিয়ে ফেলতে চাই। কিন্তু ভুলগুলোতে যেন সুপ্রভা জুঁই বেশি মুখর হয়ে যাচ্ছে। আবার যা কিছুতে লজ্জা আমার তাতেই গোপনে গোপনে কি নিবিড় প্রেম! নিজেকে ভালোবাসা কি প্রার্থনা ডায়েটের মতন? খেতেই থাকবো খেতেই থাকবো আর ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবো, “একটা কিছু চমৎকার করে দাও।” নাকি যতক্ষণ বান্দা তার তাকদির বদলাতে চায় না ততক্ষণ আল্লাহও তাকে সাহায্য করেন না, সেই নীতি ধারণ করবো?
love yourself…got it…but how?! how to be blissful..আত্ম পরিচয়- আসলে স্থির কোন ঘটনা নয়। আত্ম পরিচয় ক্রমাগত কাল থেকে কালে পাল্টে পাল্টে যাওয়া আমিটা। তাই ঐ না পাওয়ার যন্ত্রণাকে এখন উদযাপন করি আমি ও আশে পাশের আরো অনেকে। দোহাই দোহাই। দোশি তাঁর মতো করে অর্থ বুনেছেন। ঐ যে বললেন, নদী। ঐটাই তাঁর মূল ভাবনা। যুগ যুগান্তরের স্তন পান করেছি আমি। এই chaotic ধর্মই তো আমার চরিত্র।
এই পরিচয় অনেক ডাইমেনশনে অনেক লেয়ারে হাজির হয়। দোশি একজন স্থপতি হিশাবে তার স্থাপত্য ভাবনার জায়গা থেকে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন আর আমিও তাঁর পথ চলাকে আমার বুদ্ধিতে, আমার চেতনায় গ্রহণ করতে পেরেছি।
একজন ব্যক্তি স্থপতি’র সংযোগ আছে- সঙ্গীতের সাথে, চিত্রকলার সাথে, পরিবার বন্ধু বান্ধবের সাথে। ‘আমি কোথায় যাচ্ছি?’ বহমান নদী হয়ে এই প্রশ্ন করে বিশ্লেষণ করার চর্চায় হলো নদীর স্বতন্ত্র হবার মূল মন্ত্র।
এসব বলে দোশি তাঁর মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন। জানালেন, তিনি স্থপতি করবুজিয়ারের কাছ থেকে life, environment, culture, glory of celebration এর দীক্ষা নিয়েছেন।
Celebrating Habitat এই শিরোনামই বুঝিয়ে দেয় কোন মাত্রা’র চিন্তা দিয়ে ভাবছেন দোশি। তাঁর মতে house plays outside of the building… এক্কেবারে বিপরীত ভাবনার তির ছুড়লেন যেন একথা বলে। এরপরেই মনে হয় আসলেই তো! আসলেই যদি একটা বাড়ি একটা living laboratory হয় আর পাশাপাশি সেটা বাড়ির বাইরেই আরো স্পষ্ট হয় তবে একজন ব্যক্তি মানুষের চরিত্রের যে লুকোচুরি, আর সেটা থেকে আমার মুক্তির যে আকাংখা সেটিই তো সত্য হয়!!
ঐ যে পরিচিতি’র কথা বললাম সেখানেই এবার মজাটা শুরু হবে। এবারে চলে এলো তাঁর প্রজেক্ট। জানালেন ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে প্রভাবিত হয়ে উনি space manipulate করেছেন। যেহেতু এই সঙ্গীত শোনা আছে তাই সাথে সাথেই বুঝে গেলাম কি বোঝাতে চাচ্ছেন! বারবার করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কথা বললেন।
স্থাপত্যবিদ্যা পড়াশুনার সময়ে আমরা- ঘুমের, খাওয়ার, টয়লেটের, রান্নাঘরের পরিবেশের ব্যাপারে একেবারে আলাদা আলদা করে গবেষণা করেছি আর সেই পরিবেশের উপর ভিত্তি করে শুধু মাত্র ঘুমের জন্য বা অন্য অন্য একটা নির্দিষ্ট পরিবেশের জন্য স্পেস ডিজাইনও করেছি। এইটা ব্যকরণের মতই। দোশি কিন্তু এই চিন্তাকে চর্চার সময় ভেঙ্গে দিলেন। মানে ব্যকরণ জেনেই ব্যাকরণ ভাঙ্গা আর কি। উনি বলছেন living life as it come… ফলে কোন বাড়িতে summer zone বা winter zone করার মতো যে পপুলার প্রসেসটা আছে সেটাকে তিনি এক অর্থে নাকচ করছেন। এই সহজ সাধারণ একটা কথাতে খেয়াল করলাম রোদ বা বৃষ্টি বা শীত-কে আমার আর শত্রু মনে হচ্ছে না। বরং এরা যেন আমার advantage! আর এই মনে না হওয়াটা আমার সামাজিক নানা ইস্যু’র প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও কিন্তু পাল্টে দিলো! celebrating life! আর এই লাইফে আমার দেহ, সমাজ দেহ থেকে গোটা ইউনিভার্সের এনার্জি সংযুক্ত। উফফ কত্ত প্রেম!!! এই প্রেমই তো চাচ্ছি, এই প্রেমই তো আমার পরিচয়!!!!
এমন একটা বাড়ি যেটার প্রাইভেসি খুব স্ট্রং কিন্তু নেচারটা হলো প্যাভিলিয়ানের মতন! |
সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতিকে উদযাপন। আর একটা সুযোগ রাখা পরিবর্তনের। |
‘a building must have a dialogue with others and with yourself’
এও জানালেন লুই কান নাকি আরব্য রজনী পড়তেন আর এর গল্প বলতেন খুব!
তবে এই ঘটনা ডিজাইনে আনতে হলে স্থপতি-কে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ভালো করে জানতে হবে। ফলে দেখা যাচ্ছে স্থাপত্য হলো জীবন যাপনের মূল উপাদানের বাইরে আর কিছুই নয়!
কি করে পরিচিতি দেওয়া যেতে পারে লো কস্ট হাউজিং এর ইউজারদের |
লো কস্ট হাউজিং কিন্তু লো ফিল করার মতন কোন স্পেসই নাই! |
হাউজিং এর মাস্টার প্ল্যান |
দোশি বললেন, রাস্তা হলো একটা কমিউনিটির সবচেয়ে বড় এক্টিভ এবং ফলপ্রসূ জায়গা যা বহুতল ভবনে এসে হারিয়ে গেছে। এই যে আজকে মানুষ এক হয়ে কোন কিছু করে উঠতে পারে না তার পিছনে এটা একটা বড় কারণ সে যেভাবে বসবাস করছে। কারণ এতে করে তাকে পারস্পারিক নির্ভরতা তৈরির সুযোগটাই তো দেওয়া হচ্ছে না! একটা সংস্কৃতিকে, একটা গোষ্ঠীকে দৃঢ়তা দেয় তার স্থাপত্য।
দোশি বলছেন- social activism, creating, space, light এসব কিছু যখন একসাথে merge করে তখনই সেটাকে Architecture বলে।
এবারে দোশি বলতে নিলেন সেই প্রজেক্টের গল্প যেখানে যেয়ে তাঁকে প্রথম পেয়েছি।
School should be without boundaries
স্থাপত্য বিভাগ |
স্থাপত্য বিভাগ |
ক্লাসরুম |
ক্লাসরুম
স্কুল হলো সেই জায়গা যেখানে একজন মানুষ তার নিজেকে চিনতে শেখে। এজন্য তার চেতনার সীমারেখাকে ম্লান করে দেওয়াটাই হলো মূল লক্ষ্য। মূলত একটা ধ্যানের স্থান- যেখানে পানি, সবুজ, ভবনের প্রান্ত দেখা যায়। ইন শর্ট ফোকাসের জায়গা তাই প্রতিনিয়ত চমৎকৃত করে দেওয়ার চাপ নেই। খেয়াল রাখতে হবে স্কুল কোন ক্লাসরুম নয়। তাই এরকম একটা জায়গা তৈরি করার কথা ভাবেন দোশি যেখানে সকলে আসা যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আইডিয়া শেয়ার করতে পারে, বা ভাবের আদান প্রদান। তাই সারকুলেশান স্পেস হয়ে গেলো তাঁর কাজের মূল ক্ষেত্র। এই জায়গাটাকেই নানা মাত্রার কনভারসেশান স্পেসে রুপান্তর করে ফেললেন তিনি। সিঁড়ি ঘরই তখন একটা মাল্টিপল স্পেসের একটা এক্টিভিটি এরিয়া হয়ে গেলো।
No comments:
Post a Comment