দুবাইয়ের বাসিন্দারা একদিন হয়তো আবিষ্কার করবেন অনন্য ও নিয়ত পরিবর্তনশীল দিগন্ত রেখা। এর জন্য তারা ধন্যবাদ দিতে পারে ‘ডাইনামিক আর্কিটেকচার’ এর বায়ু চালিত ঘূর্ণায়মান অট্টালিকাকে। তাদের এই ধারণার ভিত্তিমূলে আছে একটি কেন্দ্রীয় কংক্রিটের কোর ও একে ঘিরে রাখা ৫৯টি ঘূর্ণায়মান লেভেলের একটি অনন্য ভবন। প্রতিটি লেভেলের মাঝে আটকে রাখা বিশাল অনুভূমিক বায়ু টারবাইনের মাধ্যমে এই ভবন নিজেই তার প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করবে।
এই রকম ধারণা অনেকের কাছেই অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য ব্যয়বহুল মনে হতে পারে তবে পেট্রোডলারের শক্তিতে বলীয়ান আরব আমিরাতে এই রকম বিশাল আর জটিল অনেক প্রজেক্টেই বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে এবং তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। তেলের দাম যদি অবিশ্বাস্য ভাবে কমে না যায় তাহলে কয়েক বছরের মধ্যেই দুবাইয়ের বাসিন্দারা এই ঘূর্ণায়মান বিস্ময়কে তাদের দিগন্তে দেখতে পাবে।
দুবাইয়ের দিগন্তের নতুন তারা; Image Source: The Independent |
একজন স্বপ্নবাজ স্থপতি
এই ঘূর্ণায়মান টাওয়ার যার চিন্তার ফসল তিনি হলেন ইতালিয়ান স্থপতি ডঃ ডেভিড ফিশার। তিনি তার দৃষ্টি নিবন্ধ করেছেন এমন সব প্রগতিশীল নকশার দিকে যেগুলো এর ব্যবহারকারীর চাহিদার উপরে ভিত্তি করে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে।ডঃ ফিশার আগে নিয়োজিত ছিলেন নিউইয়র্ক শহরের নানা পুরনো ভবন পুনঃনির্মানের কাজে। এখন তিনি কাজ করছেন নানা রকম যুগান্তকারী নির্মাণ প্রযুক্তির উন্নয়নে। তার নকশাগুলো নির্মানস্থলে তৈরি না হয়ে কারখানায় তৈরি হয় পরে নির্মানস্থলে এনে জোড়া দেয়া হয়। এর পরে নির্মাণ সময় ও লোকবল দুটোই উল্লেখযোগ্য ভাবে কম লাগে।
ডক্টর ডেভিড ফিশারের ভাবনায় স্থাপত্যের নতুন সম্ভবনা; Image Source: The Lyncean Group of San Diego |
বৈপ্লবিক নির্মাণযজ্ঞ
এই অভূতপূর্ব নির্মাণকাজের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হতে সময় লাগবে ৬ মাস। এই ভবনে কংক্রিটের তৈরি একটি কেন্দ্রীয় কোর স্থাপন করা হবে, এর সাথেই থাকবে ভবনের স্থায়ী সুযোগ সুবিধা যেমন এলিভেটর, লিফট, সিঁড়ি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এটাই এই প্রজেক্টের একমাত্র অংশ যেটা নির্মাণস্থলেই বানানো হবে। প্রতিটা ফ্লোর তৈরি করা হবে ১২ টি আলাদা আলাদা অংশ যুক্ত করে আর এই অংশ গুলো তৈরি করা হবে কারখানায়। এর ফলে খরচ যেমন অনেক কমে আসবে, তেমনি সময়ও অনেক কম লাগবে।আলাদা আলাদা ভাবে তৈরি করার কারণে প্রতিটি অংশের নিরাপত্তা ও উচ্চ মান সুনিশ্চিত করা যাবে। ১২ টি অংশের প্রতিটিতে থাকবে এর জন্য প্রয়োজনীয় সকল বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ, পানির সংযোগ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা। তৈরি করার পরে প্রতিটি অংশ নির্মানস্থলে নিয়ে আসা হবে এবং উপরের দিক থেকে এক এক করে কেন্দ্রীয় কোরের সাথে যুক্ত করে দেয়া হবে।
তার মানে এই টাওয়ারটি আসলে তৈরি হবে উপর থেকে নিচের দিকে। সম্পূর্ণ ফ্লোরে ১২টি ইউনিট সংযুক্ত করতে মাত্র এক সপ্তাহ সময় লাগবে। এখানে খেয়াল করার বিষয় হলো যেহেতু প্রতিটি ইউনিট স্বাধীন এবং বাতাসে নড়াচড়া করতে পারে তাই এগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধের বেলায়ও অনেক শক্তিশালী।
ভবনের প্রতিটা অংশ আলাদা আলাদা ভাবে সংযুক্ত করা হবে; Image Source: What’s On Dubai |
নিজেই নিজের শক্তি উৎপাদনকারী স্থাপত্য
এই ভবনের প্রতিটি ফ্লোরের মাঝে আছে বিশাল অনুভূমিক বায়ু টারবাইন। এমন টারবাইনের সংখ্যা মোট ৫৮টি। প্রতিটি টারবাইনের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ০.৩ মেগাওয়াট। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ দিয়ে প্রায় ৫০টি পরিবার তাদের যাবতীয় চাহিদা মেটাতে পারে। এই টারবাইনগুলি এমন ভাবে যুক্ত করা হয়েছে যে বাইরে থেকে তাদের দেখা যায়না বললেও চলে।কেন্দ্রীয় কোরের খুব কাছে লাগানো বলে এদের দেখভাল করাও বেশ সহজ। ভবনের নান্দনিকতা অক্ষুণ্য রেখে এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে সেটা হবে রীতিমতো বৈপ্লবিক। আর এটি হতে পারে বিকল্প শক্তির খুব ভালো একটি উৎস্য। ডায়নামিক আর্কিটেকচারের ওয়েবসাইটে দাবী করা হয়েছে যে এই ভবনে যদি সোলার প্যানেলও যুক্ত করা হয় তাহলে এই এক ভবন থেকেই বছরে ৭ মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
অনুভূমিক টারবাইন ০.৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে; Image Source: dynamicarchitecture.net |
এই ভবনের প্রতিটি টারবাইনের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ০.৩ মেগাওয়াট, সেখানে সাধারণ উল্লম্ব টারবাইন যেমন উইন্ডমিলের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১ থেকে ১.৫ মেগাওয়াট। এবার বিবেচনা করুন যে দুবাই বছরে ৪০০০ বায়ুঘন্টা পায়, তারমানে এই ভবনের টারবাইনগুলি থেকে ১,২০০,০০০ কিলোওয়াট-ঘন্টার সমান শক্তি পাওয়া সম্ভব।
সাধারণত একটি পরিবার বছরে ২৪০০০ কিলোওয়াট-ঘন্টার সমান শক্তি ব্যবহার করে, সেক্ষেত্রে ভবনের একটি টারবাইন থেকেই ৫০টি পরিবারের বাৎসরিক চাহিদার সমান শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। দুবাইতে ডায়নামিক এই ভবনে মোট ২০০টি ফ্লাট থাকবে, সেক্ষেত্রে মাত্র ৪টি টারবাইনের উৎপাদিত শক্তি দিয়েই পুরো ভবনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। অতিরিক্ত ৪৪টি টারবাইনের শক্তি দিয়ে এই ভবনের আশেপাশের বেশ বড় এলাকা আলোকিত করা সম্ভব।
আর এই শক্তি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো শক্তি না, এটি প্রাকৃতিক বিশুদ্ধ শক্তি। যদি দুবাইয়ের শুষ্ক আবহাওয়ার কথা আমরা বিবেচনা করি তাহলে দেখা যায় যে দুবাইয়ের বায়ুর গড় গতিবেগ মাত্র ১৬ কিমি/ঘন্টা। সেক্ষেত্রে ভবনের শক্তির সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ হতে হয়তো ৮টি টারবাইনের শক্তি লাগতে পারে। যদি তাও হয় তবুও ৪০টি টারবাইনের উৎপাদিত শক্তি অতিরিক্ত হিসেবে থেকে যাবে যা দিয়ে একই আকারের আরও ৫টি অট্টালিকার সকল শক্তির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
ভবিষ্যতে বদলে যাবে স্থাপত্যের সংজ্ঞা; Image Source: Inhabitat |
শক্তির বিকল্প উৎস্যের জন্য মানুষ হন্যে হয়ে আছে। সেখানে এমন উদ্ভাবনী চিন্তা আশার আলো হয়েই দেখা দেবে। যেখানে বায়ুর মতো পরিচ্ছন্ন শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তাও এর জন্য আলাদা করে জায়গা নষ্ট করতে হবেনা, নান্দনিকতার কোন ব্যাঘাত ঘটবেনা। শুধু তাই না, ভূমিকম্প প্রতিরোধেও এই নকশা অনেক কার্যকর।
আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে আপনাকে ভাবতে হবেনা যে আপনি দক্ষিণমুখী ফ্লাট নেবেন না উত্তরমুখী। যে ফ্লাটই আপনি বেছে নেন না কেন উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সব দিকই আপনার সামনে খোলা থাকবে, কারণ প্রতিটি ফ্লোর যে ধীর গতিতে ঘুরতে থাকবে।
সুত্রঃ WORLD 2050.Future World
No comments:
Post a Comment