স্থাপত্য বিষয়ে পড়ালেখায় এখন আমাদের দেশও অনেক এগিয়ে

কিন্তু স্থাপত্য প্রযুক্তিতে
সফটওয়্যারের ব্যবহারে আমরা এখনও অনেকটাই
পিছিয়ে। আধুনিক স্থাপত্য প্রযুক্তিতে নতুন নতুন
অনেক সফটওয়্যারই রয়েছে যার ব্যবহার আমাদের
দেশে তেমন নেই। এমন কিছু সফটওয়্যারের
পরিচিতি নিয়ে লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি
অব সিডনিতে উচ্চশিক্ষারত স্থপতি শফিক রাহ্মান
উন্নত দেশগুলোর থেকে আমাদের দেশের
স্থাপত্য চর্চা বা স্থাপত্যে পড়ালেখা খুব বেশি
পিছয়ে নেই। পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর
শিক্ষার মান আর বাংলাদেশের স্থাপত্য শিক্ষার মান
সমমানের। কিন্তু একটি জায়গায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি।

আর তা হলো স্থাপত্যে প্রযুক্তি এবং
সফটওয়্যারের ব্যবহার। স্থাপত্য ক্ষেত্রে নতুন
নতুন সফটওয়্যারগুলোর ব্যবহার এখনই আত্মীকরণ
করা না গেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা সময়ের
সাথে সাথে আরও বেশি পিছিয়ে পড়বে। এই
লেখায় স্থপতির বা স্থাপত্যের শিক্ষার্থীর কাজের
পরিসর অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ও
যুগোপযোগী কিছু সফটওয়্যারের ব্যবহার তুলে
ধরা হলো।

ইকোটেক্ট ও অটোডেস্ক প্রজেক্ট ভাসারি
ডিজাইন প্রক্রিয়ার শুরুতেই আসে সাইট অ্যানালাইসিস,
সাইটের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ। আমাদের দেশের
প্রচলিত ধারা হলো দিক নির্ণয় এবং আনুমানিক সূর্যের
গতিপথ বা আনুমানিক বাতাসের প্রবাহের দিক হাতে
এঁকে নির্ধারণ করা। কিন্তু এই প্রক্রিয়া মোটেই
বাস্তবসম্মত নয়। কারণ একটি সাইটের পারিপার্শ্বিক
কাঠামোর কারণে সাইটের আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্য
সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়
বাতাসের প্রবাহের কথা। একটি সাইটের
পার্শ্ববর্তী কাঠামোর অবস্থান-আকৃতি সম্পূর্ণ
ভিন্নভাবে বাতাস প্রবাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা কখনই
ধারণা নির্ভর বা ওই এলাকার সাধারণ আবহাওয়ার
বৈশিষ্ট্যকে অনুসরণ করে না। দুইটি সফটওয়্যারের
ব্যবহার এই কাজটি নিখুঁতভাবে করতে সহায়তা করবে।
প্রথমেই বলি ইকোটেক্টের (Ecotect) কথা।

যেকোনো থ্রিডি মডেলিং সফটওয়্যারে সাইটসহ
এর পারিপার্শ্বিক কাঠামোগুলোর একটি মডেলিং তৈরি
করে ইকোটেক্ট। এর মাধ্যমে ভৌগোলিক
অবস্থান অনুযায়ী বছরের বিভিন্ন সময়ের সানপাথ
ডায়াগ্রম, পারিপার্শ্বিক ভবনের ছায়াসহ নিখুঁত
পর্যবেক্ষণ করে ফেলা সম্ভব সহজেই।

একইভাবে বাতাসের প্রবাহ আর পারিপার্শ্বিক
অবকাঠামোর অবস্থান অনুযায়ী বাতাসের দিক
পরিবর্তন আর প্রবাহের বৈশিষ্ট্য সঠিকভাবে নির্ণয়
করতে ব্যবহার করা যায় অটোডেস্ক প্রজেক্ট
ভাসারি (Autodesk Project Vasary)। এই
সফটওয়্যারের মাধ্যমে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা
যাবে বাতাসের গতিপথ।

থ্রিডিএস ম্যাক্স (3ds Max) ও স্কেচআপ
(Sketchup)
বাংলাদেশে বহুলব্যবহূত এই দুইটি সফটওয়্যার মূলত
প্রথমিক ডিজাইন, স্থাপতিক ভাষায় ‘কনসেপচুয়াল ডিজাইন’
এবং ‘প্রাইমারি ফর্মে’র অনুশীলনের জন্য পরিচিত।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন পরবর্তী
ভিজ্যুয়ালাইজেশনে এই সফটওয়্যারগুলো ব্যবহূত
হয়ে থাকে। কিন্তু বিল্ডিং ভিজ্যুয়ালাইজেশনকে এখন
আলাদা ভাগ হিসাবে দেখা হয় না। ডিজাইন সফটওয়্যারের
ব্যবহার একইসাথে বিল্ডিংয়ের প্ল্যান, সেকশন,
এলিভেশন ও ভিজ্যুয়ালাইজেশন—সবকিছু
স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়।

বিল্ডিং ইনফরমেশন মডেলিং (Building Information
Modeling-BIM) ও রেভিট আর্কিটেকচার (Revit
Architecture)
বিল্ডিং ইনফরমেশন মডেলিং বা সংক্ষেপে বিআইএম
বিশ্বব্যাপী একটি আলোড়ন তৈরি করা ডিজাইন
প্রযুক্তি। বিআইএম-এর জন্য বেশকিছু সফটওয়্যার
প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে বহুলব্যবহূত দুইটি
সফটওয়্যার হলো রেভিট ও আর্কিক্যাড।

বাংলাদেশে এগুলোর ব্যবহার খুবই সীমিত।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের ডিজাইনের জন্য
এখনও অটোক্যাডই (AutoCAD) ব্যবহূত হয়ে
থাকে, যা উন্নত বিশ্বে আর তেমন ব্যবহূত হয় না।

বিআইএম সফটওয়্যারে ডিজাইনের মূল বৈশিষ্ট্য
হলো এটি একইসাথে পুরো ডিজাইন সিস্টেমকে
তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি ভবনের
প্ল্যান আঁকালে এই সফটওয়্যারে একইসাথে
সবগুলো এলিভেশন এবং থ্রিডি ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি
হয়ে যায়। যেকোনো পরিবর্তন সমগ্র ডিজাইনে
একইসাথে পরিবর্তন নিয়ে আসে। যেমন—একটি
বহুতল ভবন ডিজাইনের পরে স্থপতি এলিভেশন
দেখে কিছু জানালা পরিবর্তন করতে চাইলেন। তিনি
এলিভেশনে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করে দিলে
সমগ্র প্ল্যানের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন
স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হবে।

আবার বড় কোনো প্রজেক্টের নির্মাণ সংক্রান্ত
ড্রয়িং বা ওয়ার্কিং ড্রয়িং করতে দীর্ঘ সময় লাগলেও
বিআইএম সফটওয়্যারে ডিজাইন শেষ হওয়ার সাথে
সাথেই ওয়ার্কিং ড্রয়িং তৈরি করা সম্ভব। এতে ডিজাইন
শেষ করার সাথে সাথেই বিস্তারিতভাবে সকল ডোর
ও উইন্ডোজ শিডিউলও তৈরি হয়ে যায়। শুধু তাই নয়,
প্রজেক্টের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ইঞ্জিনিয়ার ও
স্থপতি বিআইএম সফটওয়্যারে একইসাথে কাজ
করতে পারে। তাই বর্তমানে বিশ্বের
শীর্ষস্থানীয় সব প্রতিষ্ঠান এখন বিআইএম
সফটওয়্যারেই ডিজাইন, ড্রাফটিং ও যাবতীয় নির্মাণ
সংক্রান্ত ড্রয়িং করে থাকে।

রাইনোসেরস থ্রিডি (Rhinoceros 3D) ও গ্রাসহপার
(Grasshopper)
লন্ডন অ্যাকুয়াটিকস সেন্টার বা ব্রিড প্যাভিলিয়নের
মতো জটিল সব বিস্ময়কর স্থাপনার মূলে রয়েছে
জ্যামিতিক ও গাণিতিক সূত্রের প্রয়োগ। এই ধরনের
ডিকনস্ট্রাকটিভ বা স্মুথ কার্ভ ফর্ম ডিজাইন করার
উপযোগী সফটওয়্যারের মধ্যে রয়েছে
রাইনোসেরস থ্রিডি ও গ্রাসহপার। আন্তরিকতার সাথে
চেষ্টা করলে এসব সফটওয়্যারেও দক্ষতা অর্জন
করা সম্ভব অল্প সময়ে। এসব সফটওয়্যারে দক্ষতা
না থাকলে বিশ্বখ্যাত সব স্থাপতিক প্রতিষ্ঠানে
কাজের সুযোগ মিলবে না, সেটা বলাই যায়।

ডিজাইন বিল্ডার (Design Builder)
এনার্জি ম্যানেজমেন্ট বা সাসটেইনিবিলিটি নিয়ে
যেসব স্থপতি কাজ করছেন, তাদের কাজকে
গুছিয়ে নিয়ে করার সুযোগ রয়েছে ডিজাইন বিল্ডার
নামের আধুনিক এক সফটওয়্যারে। কোনো ভবন
নির্মাণের আগেই ভবনটির ভেতরের তাপমাত্রা
পরিমাপ, প্রতিটি স্পেসের এনার্জি বিশ্লেষণ করে
প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়াল নির্ধারণ করা,
প্রয়োজনীয় শেডিং ডিভাইস, লুভার নির্ধারণ করা,
প্রয়োজনীয় লাইটিং সিস্টেম নির্ধারণ, নির্মাণের
আগেই সারাবছরে ব্যবহূত শক্তির পরিমাণ নিরূপণ—
এসব কাজ ডিজাইন বিল্ডারে করে ফেলা যায়
সহজেই। মোট কথা, সাসটেইনিবিলিটি নিয়ে কাজ
করার পূর্ণ সুযোগ রয়েছে এই সফটওয়্যারে।

প্রযুক্তির ছোঁয়া আমাদের জীবনযাত্রাকে বদলে
দিচ্ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। তার সাথে সামঞ্জস্য
রেখে আধুনিক প্রযুক্তির সকল সুবিধা গ্রহণ না
করতে পারলে আমরা অন্যদের থেকে পিছিয়েই
থাকব। তাই স্থাপত্যবিদ্যায় নতুন নতুন সব
সফটওয়্যারের ব্যবহারে সকলকে এগিয়ে আসতে
হবে।

No comments

Powered by Blogger.