স্থাপত্য, ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচার, নগর পরিকল্পনা এই অঙ্গনেও চলছে চিন্তার ঝড়। করোনা পরবর্তীতে আমাদের কিভাবে শহর, গ্রাম কে টেকসই বানানো যায়-কাজী যায়েদ তিতুমীর

কোভিড-১৯, বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এর নাম। এই ভাইরাস এর প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পড়েনি এমন যায়গা হয়তো পাওয়া যাবেনা। ইতিমধ্যে আমরা কম বেশি সবাই করোনা ভাইরাস এর ব্যাপারে জানি।
Landscape Architecture and Design Services - Arup
বাংলাদেশের প্রত্যেকটি শহরের ট্রাফিক আইল্যান্ড ও বিল্ডিং এর সেটব্যাক, মেইন রোড এর পাশের খালি যায়গা গুলোতে নগর সৌন্দর্যবৃদ্ধিকারী বৃক্ষ রোপন করা হয়। শহর কে প্রাথমিক ভাবে বিভিন্ন প্রকার বৃক্ষরোপন এর মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়। এর পিছনে ধার্য করা থাকে নির্দিষ্ট বাজেট এবং লোকবল। এর মধ্যে আছে গাছ এর সিলেকশন, গাছ ক্রয়, রোপন ও নিয়মিত পরিচর্যা। আমাদের নগর সৌন্দর্যবৃদ্ধিকারী এই বৃক্ষরোপন কর্মসূচির মধ্যে মূলত দেবদারু, বল শ্যাওড়া, চাইনিজ টগর, দেশি-বিদেশী বর্ডার প্ল্যান্ট, বোস্টন/রয়াল ফার্ন, মনিরাজ প্রভৃতি গাছ ব্যাবহার করা হয়। এই গাছ গুলো দেখতে খুবই সুন্দর এবং সৌন্দর্যবৃদ্ধি ই এর মূল ফাংশন। কিছু কিছু গাছ ব্যাবহার হয় সলিড ফলিয়েজ মাসিং এর জন্য যেমন শ্যাওড়া ও টগর। আবার কিছু গাছ ব্যাবহার হয় তাদের ফুলেল সৌন্দর্যের জন্য যেমনঃ গাঁদা, ডালিয়া প্রভৃতি। এই গাছ গুলো অধিকাংশই অগভীর মাটির গুল্ম এবং বিরুৎ জাতীয় গাছ। কিন্তু এই গাছ গুলো দেখতে খুবই সুন্দর হলেও এর পিছনে রয়েছে অনেক পরিচর্যা এবং সৌন্দর্য ব্যাতীত এই গাছগুলি অন্য কোন দায়িত্ব পালন করেনা। কাজেই, হয়তো করোনা পরবর্তী যে আমাদের ভাবনা র ব্যাপক পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে তার ভিতরে এগুলোর পরিবর্তন গুলোও থাকতে পারে।

ঢাকা, দিল্লি র মতন ঘনবসতিপূর্ণ শহর গুলতে অসংখ্য পথশিশু, ভবঘুরে আছে যাদের বসবাসের যায়গা ই রাস্তার পাশের কোন এক কুঁড়েঘর বা বস্তি। করোনার এই ভয়ংকর সময়ে তাদের জীবনে পড়েছে ভয়ঙ্কর প্রভাব। তাদের এই পরিস্থিতিতে না সম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজার রাখা, না সম্ভব খালি পেটে অনাহারে দিন যাপন করা। কারন এদের অধিকাংশই গৃহকর্মী, রিক্সাচালক বা রাস্তা থেকে প্লাস্টিক লোহা কুড়ায়। এদের জন্য বিভিন্ন সংগঠন দিনরাত এক করে খাদ্যের সরবরাহ করে যাচ্ছে।
আমরা আমাদের শহরের বৃক্ষ রোপনের সময় কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক ফলজ গাছ বা বহুবর্ষজীবি সবজী যদি রোপন করি সেক্ষেত্রে এই ছিন্নমূল মানুষ গুলোর জন্য কিছুটা হলেও ভিন্নধর্মী খাদ্যের ও ভিটামিন এর সরবরাহ করা সম্ভব। এই গাছ গুলোর হয়ত মূল উদ্দেশ্য ই হবে পথচারীদের খাদ্যের যোগান দেয়া। রাস্তার পাশের খালি যায়গা তে আমরা কৃষ্ণচূড়া, পলাশ এর বদলে যদি আম, জাম, লিচু র মত ক্ষুদ্রাকৃতি ফল বিশিষ্ঠ গাছ রোপন করি তবে সেগুলো ছায়া প্রদান কারী, অক্সিজেন সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করবে এবং সেই সাথে খাদ্যের ও যোগান দিবে। আমাদের দেশীয় ফলজ গাছ গুলো তুলনামূলক ঘাত সহ, গভীর শেকড় বিশিষ্ঠ ফলে সহজে ঝড়ে উপড়ে পড়ে না, এবং কম পরিচর্যা তে বেড়ে উঠে।
চিকন ডিভাইডার আইল্যান্ড গুলোতে অগভীর মাটির গাছ যেমন পেঁপে, ডালিম, জামরুল, আতা যাতীয় গাছ লাগানো যেতে পারে। এখানে উল্লেখিত গাছ গুলোকে “Feature plants” হিসেবে ব্যাবহার করে যাবে এবং গ্রাউন্ড কভারেজ এর জন্য বুনো ফলগাছ লাগানো যেতে পারে যেমনঃ ব্ল্যাকবেরী। এই গাছ গুলোর নান্দনিকতা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এই গাছ গুলো যে শুধুমাত্র পথচারী দের আহার প্রদান করবে তাই ই নয় বরং বিভিন্ন প্রজাতীর প্রানী যেমনঃ কাঠবিড়ালী, বাদুড় এবং বিভিন্ন ধরনের পাখি দের এবং পোকামাকড় দের ও খাদ্য ও আবাসস্থল হিসেবে কাজ করবে। আমরা আমদের নগরায়নে হয়ত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি বসবাসকারী মানুষ দের। কিন্তু হয়তো এখন সময় এসেছে আমাদের ভাবনার। হয়তো এখনই সময় সকল প্রকার প্রজাতিদের নিয়েই একটি নাগরীক বাস্তুসংস্থান তৈরী করার।

তুরস্কের সেলচুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনায় উঠে আসছে যে, হয়ত অদূর ভবিষ্যতে “Urban Edible Landscape” অর্থাৎ নগরীতে ভোজ্য বনায়ন ই হয়ে উঠবে টেকসই নগরায়নের একটা বড় চাবিকাঠি। বাংলাদেশের মত দেশ যেখানে পথশিশু দের খাদ্যের যোগান করতেই নাভিশ্বাস অবস্থা হয়, সেখানে নগরীতে Ornamental বা শুধুমাত্র সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছ এর বদলে “সকলের জন্য উন্মুক্ত” দেশীয় বহুবর্ষজীবি ফলজ গাছ এর ব্যাবহার হয়ে উঠতে পারে আমাদের জন্য একটি বড় করোনা পরবর্তী ভাবনা।

তথ্যসূত্রঃ https://www.researchgate.net/publication/316429675_The_Importance_of_Edible_Landscape_in_the_Cities

লিখেছেনঃ
কাজী যায়েদ তিতুমীর,
প্রভাষক,
স্থাপত্য ডিপার্টমেন্ট,
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।


কার্টেসীঃ ভূমি ভাবনা

No comments

Powered by Blogger.